গ্রাম আদালতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে রয়েছে চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের গ্রাম আদালতে সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়লেও নারীদের অংশগ্রহণ এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেবাগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরুষ ৬৯ শতাংশ, আর নারী মাত্র ৩১ শতাংশ।
২০২৩ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে ৫৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেছেন, গ্রাম আদালতের সেবাকে আরও জেন্ডার-সেন্সিটিভ (লিঙ্গ-সংবেদনশীল) ও ইনক্লুসভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) করে তুলতে হবে। তাদের মতে, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামীণ নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজে বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অপরিহার্য।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত 'গ্রামীণ নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য লিঙ্গ-সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গ্রাম আদালত সেবা প্রচারের গুরুত্ব' শীর্ষক এক গোলোটেবিল আলোচনায় এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।
মূল প্রবন্ধে 'অ্যাক্টিভেটিং ভিলেজ কোর্টস ইন বাংলাদেশ (এভিসিবি) ফেজ-৩ প্রকল্প'-এর জেন্ডার অ্যানালিস্ট শামিমা আক্তার শাম্মী বলেন, "ইউনিয়ন পরিষদে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশের অভাব এবং নেতৃত্বে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সংকট তাদের বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করছে।"
তিনি বলেন, জরিপে দেখা গেছে, গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার ৭৫ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা বৃদ্ধির ফলে মামলা দায়েরের হার বেড়েছে। দায়ের হওয়া মামলার ১৫ শতাংশের আর্থিক মূল্য ৭৫ হাজার টাকার বেশি এবং ৩ শতাংশ স্ত্রী কর্তৃক দায়েরকৃত বকেয়া ভরণপোষণসংক্রান্ত। তবে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অনেকেই এ নতুন বিধানের বিষয়ে এখনো অবগত নন।
নারীর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তিতে গ্রাম আদালত গুরুত্বপূর্ণ হলেও অধিকাংশ নারী এখনো এ অধিকারের বিষয়ে সচেতন নন। নারীদের জন্য প্রধান বাধা হলো—আইনি সচেতনতার অভাব, তথ্য ঘাটতি ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা, যাতায়াত সমস্যা, সামাজিক নিরুৎসাহ, নিরাপত্তা সংকট, পরিচ্ছন্ন টয়লেট ও অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, পরিষেবা প্রদানকারীদের আচরণগত সীমাবদ্ধতা এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হয়রানি ও অসম্মানের ভয়।
উদ্বোধনী বক্তব্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকসুদ জাহেদী বলেন, "এই প্রকল্প ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে এবং ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলবে। প্রতিটি গ্রাম আদালতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ঘটলে কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। যেসব আদালত ভালো কাজ করবে তাদেরকে বার্ষিক মূল্যায়ন ও ইনসেনটিভ দেওয়া হবে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রান্তিক মানুষের সুখ-দুঃখ গ্রাম আদালতের সঙ্গে জড়িত, তাই এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন।"
সরকার বর্তমানে ৬১ জেলার ৪,৪৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত পরিচালনা করছে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগকে সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
'এভিসিবি থ্রি প্রকল্প'-এর জাতীয় প্রকল্প সমন্বয়কারী বিবাশ চক্রবর্তী বলেন, "মোট দায়ের হওয়া মামলার ৭৮ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। গড়ে ১৮ দিনে প্রতিটি মামলা সমাধান হয়েছে মাত্র ৩২৮ টাকায়। এর মাধ্যমে সারাদেশে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সেবা পেয়েছেন।"
গ্রাম আদালতের নারী প্রতিনিধি রত্না আখতার কর্মসূচি সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, "আমরা গ্রাম আদালতে আসা উভয় পক্ষকে বসিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।"
ইউএনডিপি'র সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি মো. আনোয়ারুল হক বলেন, "জেলা আদালত থেকে প্রায় ১০ হাজার মামলা গ্রাম আদালতে পাঠানো হয়েছে। এটি প্রমাণ করে প্রশাসন এবং জনগণ উভয়ই গ্রামীণ আদালতের প্রতি আস্থা রাখে।"
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, "গ্রাম আদালতে নারীদের সহজে বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারা যদি বিনা খরচে উপকৃত হতে পারে, তবে গ্রামীণ নারীরাই প্রকৃত অর্থে লাভবান হবেন।"