আমি কোটি টাকার মালিক নই, আমার সব টাকা দুদক নিয়ে যেতে পারে: সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক

'আমি কোটি টাকার মালিক নই, আমার সব টাকা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিয়ে যেতে পারে' বলে আদালতে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ১০ কাঠার প্লট নেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ইব্রাহিম মিয়া। গ্রেপ্তারের শুনানি চলাকালে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এদিন সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটের দিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে খায়রুল হককে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। সকাল ১০টা ৩২ মিনিটের দিকে তাকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়। তিনি অসুস্থ থাকায় কাঠগড়ায় তাকে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়।
সকাল ১১টায় বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপর দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান ১০ কাঠার প্লট দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়ে শুনানি করেন। শুনানির এক পর্যায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আদালতে কিছু বলার অনুমতি চান। তখন বিচারক তাকে আসামির কাঠগড়া থেকে এজলাসের ডায়াসের সামনে আসতে বলেন।
ডায়াসের সামনে এসে খায়রুল হক বলেন, "সবাই যেভাবে প্লটের জন্য আবেদন করে, আমিও সেভাবেই করেছি। ২২-২৩ বছর আগের কথা, কারওই মনে থাকার কথা না। সে সময় আমি লিখেছিলাম, আমার টাকা নেই। অবসরে যাওয়ার পর টাকা দেব। টাকা না থাকা তো কোনো অপরাধ না। আমার এত টাকা ছিল না। সেই কারণে রাজউককে জানিয়েছিলাম, অবসরের পর টাকাটা দেব। অবসরের পর যে টাকা বাকি ছিল, সব টাকা আমি পরিশোধ করেছি। এরপর আমাকে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হয়েছে। বিচারক হিসেবে আমার কাছে টাকা না থাকা কোনো অপরাধ না।"
তিনি আরও বলেন, "আমার বয়স ৮১ বছর। দুই সপ্তাহ আগে হার্ট অ্যাটাক হয়। আমি অসুস্থ। এ ছাড়াও আমি ডজনখানেক রোগে আক্রান্ত। এগুলো বিবেচনা করে যা করার করবেন।"
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, "আমি বিভিন্ন আলোচিত মামলাসহ অনেক মামলার রায় দিয়েছি। এগুলো শেষ করতে আমার পৌনে তিন বছর লেগেছে। তখন মাথা তোলার সময় ছিল না। ওই সময়ে বিচার বিভাগের জন্য অনেক কাজ করেছি। রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার পর আমাকে ও সুলতানা কামালসহ তিনজনকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করা হয়েছিল। আমাদের প্রতি মাসে বেতন ছিল সাড়ে ৯ হাজার ডলার। আমরা ১৮ মাস কাজ করেছিলাম, কিন্তু এক টাকাও নিইনি। কেন নিইনি? চেয়েছিলাম এই টাকাটা রানা প্লাজায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা যেন পায়। কোথাও থেকে কোনোভাবে সুবিধাভোগী হইনি।"
এ সময় দুদকের আইনজীবী হাফিজুর রহমান বলেন, "দুর্নীতি দমন কমিশন সঠিক তদন্ত ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে না। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। খায়রুল হককে গ্রেপ্তার দেখানো হোক। বিচারে সব তথ্য প্রকাশ পাবে।"
এরপর সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, "৪২টি মামলার রায় দিয়ে আমি অবসরে যাই। তখন থেকে এখন পর্যন্ত দুদক আমাকে কোনো নোটিশ পাঠায়নি। আমি কোটি টাকার মালিক নই। আমার সব টাকা দুদক নিয়ে যেতে পারে।"
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোনায়েম নবী শাহিন বলেন, "সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক একজন সৎ বিচারক। বিচারের কাজ করে সংসার চালাতে তখন তার অনেক কষ্ট হতো। মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, বকেয়া টাকা তিনি পরে পরিশোধ করেছেন। রাজউক সুদের টাকা মওকুফ করলে সেটা তার দোষ হওয়ার কথা নয়। তিনি কখনোই মওকুফ চাননি।"
এরপর বিচারক বলেন, "রাজউক যা টাকা চেয়েছিল, তা পরিশোধ করেছিলেন?"
তখন সাবেক বিচারপতি বলেন, "আমাকে যা বলত, তা-ই দিতাম। যত কষ্টই হোক, সব পরিশোধ করতাম। রাজউক কর্তৃপক্ষ মওকুফ করেছে, সেখানে আমার কোনো দোষ নেই। আমি কখনো মাফ চাইনি।"
এদিকে, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের জামিন চেয়ে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোনায়েম নবী শাহিন। জামিন শুনানিতে তিনি বলেন, "আসামি একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ। সার্বিক দিক বিবেচনা করে তার জামিনের প্রার্থনা করছি।" দুদকের আইনজীবী হাফিজুর রহমান এই জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নাকচ করে এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন।
শুনানি শেষে পুলিশ তাকে আবারও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কারাগারে নিয়ে যায়।
এর আগে, গত ৬ আগস্ট দুদকের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এতে খায়রুল হকসহ ৮ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন—রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা, সদস্য (অর্থ ও এস্টেট) আ. ই. ম. গোলাম কিবরিয়া, সদস্য মো. আবু বকর সিদ্দিক, সদস্য (পরিকল্পনা) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সিকদার, সদস্য (এস্টেট) আখতার হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক যুগ্ম সচিব ও সদস্য (উন্নয়ন) এম. মাহবুবুল আলম এবং সদস্য (প্রশাসন ও ভূমি) নাজমুল হাই।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, রাজধানীর ২ নম্বর শিক্ষা সম্প্রসারণ সড়কে (নায়েম রোড) পৌনে ১৮ কাঠা জমির ওপর ৬ তলা পৈতৃক বাড়ি রয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের। কিন্তু তিনি দেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে 'দ্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস) রুলস, ১৯৬৯'-এর ১৩ নম্বর বিধি লঙ্ঘন করে হলফনামা দাখিল করে রাজউকের ১০ কাঠা প্লট বাগিয়ে নেন।
আরও বলা হয়, খায়রুল হক প্লট বরাদ্দের শর্ত ভঙ্গ করে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। রাজউকের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সুদ মওকুফের কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও তিনি প্লট বরাদ্দের সাময়িক বরাদ্দপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেন। তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুদসহ কিস্তির টাকা জমা না দিয়ে অবসরের পর, অর্থাৎ বরাদ্দের ৫ বছর পর, সুদবিহীনভাবে টাকা জমা দেন। এক্ষেত্রে রাজউকের প্রচলিত নীতিমালা ভঙ্গ করে বিশেষ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে সুদবাবদ ৪ লাখ ৭৪ হাজার ২৪০ টাকা পরিশোধ না করে তিনি সরকারের ক্ষতিসাধন ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উল্লেখ্য, গত ২৪ জুলাই সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে যুবদল কর্মী আব্দুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় ওই দিন রাতে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে গত ৩০ জুলাই বিচারক হিসেবে দুর্নীতি ও বিদ্বেষমূলকভাবে বেআইনি রায় প্রদানসহ জাল রায় তৈরির অভিযোগে শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর থেকে তিনি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।