আত্মহত্যা না হত্যা? ২৯ বছরেও খোলেনি সালমান শাহর মৃত্যুরহস্যের জট

বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহের মৃত্যুর ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কাটেনি রহস্যের জাল। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু কি 'আত্মহত্যা' ছিল, নাকি 'হত্যাকাণ্ড'—এই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তিন দশকের এই দীর্ঘ সময়ে একাধিক তদন্ত সংস্থা এটিকে 'আত্মহত্যা' বলে প্রতিবেদন দিলেও তা মানতে নারাজ তার পরিবার ও অগণিত ভক্ত।
কী ঘটেছিল সেদিন?
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় ঢাকার নিউ ইস্কাটন গার্ডেন এলাকার ভাড়া বাসায় সালমান শাহর নিথর দেহ পাওয়া যায়। তার স্ত্রী সামিরা হকের ভাষ্যমতে, 'ড্রেসিংরুমের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমানকে দেখতে পেয়ে মরদেহ নামানো হয়।' পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওই দিনই সালমান শাহের বাবা প্রয়াত কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন।
অপমৃত্যুর মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সালমানের বাসায় ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু সালমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল ও তার স্ত্রী সামিরা বলেন, 'সালমান রাত জেগে কাজ করেছে। এখন তাকে ঘুম থেকে ডাকা যাবে না।'
তিনি প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসায় ফিরে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেলিম নামের একজন ফোন করে জানান, সালমানের কী যেন হয়েছে। সালমানের বাবা, মা ও ভাই ততক্ষনাৎ সালমানের বাসা ছুটে গেলে তার শয়নকক্ষে সালমানের নিথর দেহ দেখতে পান তারা।
ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন, সেই সত্য না জানার কষ্ট নিয়েই ২০০২ সালে মারা যান সালমান শাহের বাবা।
বিচার চেয়ে ২৯ বছরের লড়াই
অপমৃত্যু মামলা দায়েরের এক বছর না ঘুরতেই, ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই, কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করেন। এরপর থেকে শুরু হয় দীর্ঘ ও জটিল আইনি প্রক্রিয়া।
প্রথমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে সালমানের মৃত্যুকে 'আত্মহত্যা' বলে উল্লেখ করা হয়। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতিবেদনটি গৃহীত হয়। কিন্তু সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে সালমানের বাবা দায়রা আদালতে একটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের ১৯ মে আদালত মামলাটি দ্বিতীয় দফায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য পাঠান। প্রায় ১১ বছরে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট তৎকালীন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এই প্রতিবেদনেও সালমানের মৃত্যুকে 'অপমৃত্যু' হিসেবেই উল্লেখ করা হয়।
সালমানের মা নীলা চৌধুরী ২১ ডিসেম্বর সেই প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে একটি নারাজি আবেদন দাখিল করেন। সেই আবেদনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, নজরুল শেখ, সামিরা হক, লতিফা হক লুসি, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও মনোয়ারা বেগম—এই ১১ জন সালমান শাহর 'হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত' থাকতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়। আদালত তখন মামলাটি তদন্তের জন্য র্যাবকে নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ এতে বাধা দেয় এবং র্যাবকে দেওয়া তদন্তভারের আদেশের বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করে। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন ঢাকার বিশেষ জজ-৬ এর বিচারক ইমরুল কায়েস (বর্তমানে বিচারপতি) রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশন মঞ্জুর করেন এবং র্যাব মামলাটি তদন্ত করতে পারবে না বলে আদেশ দেন। এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিবিআইয়ের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন মর্মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদের আদালত ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সেই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন। এরপর সালমান শাহর পরিবার আবারও রিভিশন আবেদন করলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস তা গ্রহণ করেন। মামলাটি বর্তমানে সেই রিভিশন আবেদনের শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, 'মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি মর্মে আমরা রিভিশন দায়ের করেছি। আবেদনকারী সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী অসুস্থ থাকায় ইংল্যান্ডে রয়েছেন এবং তার ভাই আলমগীর কুমকুম পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে মামলাটি পরিচালনা করছেন। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর মামলাটি শুনানির জন্য তারিখ ধার্য রয়েছে।'
পরিবারের চোখে এটি 'হত্যাকাণ্ড'
সালমান শাহের পরিবার শুরু থেকেই এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে আসছে। তার মা নীলা চৌধুরী মুঠোফোনে টিবিএসকে বলেন, 'একটা মায়ের আর কী চাওয়া থাকতে পারে? ২৯ বছরেও সন্তান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। আমার একটাই দাবি, আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চাই।'
'কী দোষ ছিল তার [সালমান শাহ], কেনই বা তারা তাকে হত্যা করলো!',যোগ করেন মা নীলা।
সালমানের মামা আলমগীর কুমকুম বলেন, 'বিচারের মালিক আল্লাহ। বিচার দেখতে দেখতে ৬৭ বছর পার হয়ে গেল। এত দিনেও বিচার হয়নি, আশাকরি এই সরকারের সময়ে বিচার হবে। আমাকে আদালত থেকে ডাকা হয়েছে। বিগত সরকার একতরফা ভাবে বিচার করে গেছেন। বর্তমান সরকারের প্রতি আমরা আশাবাদী।'
তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, 'পরিবারে কেউ মারা গেলে থানা থেকে সবাইকে ডাকা হয়। গ্রেপ্তার হয়, রিমান্ডেও নেওয়া হয়। কিন্তু এসবের কিছুই করা হয়নি। সালমান শাহকে ঝুলন্ত অবস্থায় নামিয়ে গোসল করালো, নতুন কাপড় পড়ালো। সালমান শাহ অসুস্থ, সে তার মাকে ফোন দিয়ে পর্যন্ত জানালো না। এমনকি ঘটনার দিন বাড়িতে থাকা কোনো কাজের লোকজনও নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'ঘটনার পর বাড়ির কাজের মানুষ—ডলি, মনোয়ারা, আবুলকে পর্যন্ত থানা থেকে ডাকা হয়নি। এর ভেতর তো রহস্য আছে। আমার একটাই দাবি, প্রকৃতি অপরাধীরা যেন বের হয়ে আসে এবং তারা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হয়।'
ভক্তদের দাবিও অভিন্ন। অহিত নামে সালমান শাহ-র এক ভক্ত বলেন, 'গত ২৬ আগস্ট ঢাকার জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে
বিচার চেয়ে আমারা মানববন্ধন করেছিলাম। সারাদেশের মানুষ তাকে অনেক ভালোবাসে। মামলায় অনেক গাফিলতি রয়েছে। ঘটনার বিষয়বস্তু দেখে বোঝা যায়, এটা হত্যাকাণ্ড।'
সালমান শাহ-র মৃত্যুতে 'বাড়ির গৃহকর্মী' ও 'সাবেক স্ত্রী' অভিযুক্ত বলে দাবি করেন এই ভক্ত।