ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের ৩৬ দফা ইশতেহার ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ৩৬ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল 'ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট'। এটি আগামী এক বছরে এসব ইশতেহার বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছে।
আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় ডাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ইশতেহার পাঠ করেন প্যানেলের সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদ প্রার্থী মহিউদ্দিন খান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ছয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে ইশতেহার বাস্তবায়ন করা হবে। এগুলো হলো— নিরাপদ ক্যাম্পাস, আবাসন সংকট সমাধান, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, উন্নত পরিবহন এবং ক্যারিয়ার গঠনে পর্যান্ত তথ্য ও সেবা।
ইশতেহারে ছয়টি বিষয়কে 'না' বলে উল্লেখ করেছে প্যানেলটি। এগুলো হলো- ইশতেহারে বলেছে, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি, নির্যাতন ও সহিংসতা,গণরুম-গেস্টরুম কালচার,বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণ,মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, 'লাঞ্চের পরে আসেন' কালচার, ইসলামোফোবিয়া ও সাইবার বুলিং বন্ধ করবেন তারা।
প্যানেলটির ৩৬ দফা ইশতেহার
১। ডাকসু নির্বাচনকে একাডেমিক ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতি বছর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন বাস্তবায়ন করা।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করা। ফ্যাসিবাদের চিহ্ন ও ফ্যাসিবাদী কাঠামো, ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও চর্চার পুনরুৎপাদন রোধ করা। গেষ্টরুম, গণরুম কালচার ফিরে আসার সকল পথ রুদ্ধ করা। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্তৃক নৃশংস হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আইনি শাস্তি নিশ্চিত করা। একই সাথে সাম্য, মোফাজ্জল ও আবু বকর হত্যাসহ ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত সকল নিপীড়নের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা।
৩।প্রথম বর্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বৈধ সিট নিশ্চিত করা। আবাসন সংকটের অস্থায়ী সমাধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে অস্থায়ী হোষ্টেল বা মাসিক আবাসন ভাতার ব্যবস্থা করা এবং স্থায়ী সমাধান হিসেবে হল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিতকরণে হল ও অন্যান্য ক্যান্টিন-ক্যাফেটেরিয়াতে পুষ্টিবিদের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর খাবারের মেন্যু প্রণয়ন এবং ৩ মাস অন্তর খাবার মান পরীক্ষা করা। প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিতে মানসম্মত ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যান্টিনের বাবস্থা করা। আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ 'মিল ডাউচার' চালু করা।
৫। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করা। ছাত্রী হলে পুরুষ কর্মচারী যথাসম্ভব কমিয়ে আনা এবং প্রক্টরিয়াল টিমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী সদস্য নিয়োগ দেওয়া।
৬। ছাত্রীদের জন্য ছাত্রী হলে প্রবেশের বিধি-নিষেধ শিথিল করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র প্রদর্শন-সাপেক্ষে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া। ছাত্রী হলে অভিভাবকদের জন্য 'গার্ডিয়ান লাউঞ্জ' স্থাপন করা।
৭। ছাত্রীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান কার্যকর করা। মাতৃত্বকালীন সময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ক্লাসে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা শিথিল করা।
৮। কমনরুমে নারী কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া। মা শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং রুম এবং চাইল্ড কেয়ার কর্নার স্থাপন করা।
৯। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সেবাকেন্দ্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নিরসন করে 'পেপারলেস রেজিস্ট্রার বিল্ডিং' গড়ে তোলা। উচ্চ শিক্ষায় বিদেশে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা।
১০। ডাকসু ওয়েবসাইট উন্নতকরণ এবং অ্যাপের মাধ্যমে অ্যাক্সেস টু রিসোর্সে নিশ্চিত করা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা।
১১। শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিকে আরো কার্যকর করা এবং প্রতিটি বিভাগে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলে 'মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম' চালু করা। প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিতে ই-লাইব্রেরি ও কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন করা।
১২। শিক্ষার্থীদের নিয়ে রিসার্চ-বিষয়ক কর্মশালা করা। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ফেষ্ট আয়োজন করা। স্মল রিসার্চ গ্র্যান্ট ও রিসার্চ ট্রাভেল গ্র্যান্ট চালু করা। গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা ও গবেষণা সহজলভা করা। নিয়মিত সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজন করা এবং উচ্চমানের প্রকাশনা নিশ্চিত করা।
১৩। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বিজ্ঞান লাইব্রেরি, হल লাইব্রেরি ও পাঠকক্ষ এবং ডিপার্টমেন্টের সেমিনার কক্ষে সম্প্রসারণ করা। এগুলোর নিশ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য আরো সহজলভ্য করা। লাইব্রেরিসমূহ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসা।
১৪। সফট স্কিল ডেভেলপমেন্টের ওপর ওয়ার্কশপ আয়োজন করা। উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার-বিষয়ক সেমিনার, কর্মশালার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে জব ফেয়ার আয়োজন করা। তরুণ উদ্দ্যোক্তাদের নিয়ে স্টার্ট-আপ সামিট আয়োজন করা।
১৫। অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
১৬। কেন্দ্রীয় মসজিদ, হল মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয় সমূহের অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়ন করা। ছাত্রীদের ইবাদতের জন্য একাডেমিক এরিয়া বিশেষ করে কার্জন হল এলাকায় উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ।
১৭। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং সেবার পরিসর বৃদ্ধি করা।
১৮। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার ও সেবা আধুনিকীকরণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি করা এবং ডিইউএমসি অ্যাপ চালুর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবাকে আরো বেশি সহজলভ্য করা। মেডিকেল সেন্টারে চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া। বিশেষ করে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নারী চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা।
১৯। সারা দেশে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকদের চিকিৎসাবায়ের ওপর বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্য বীমাকেন্দ্রীক ভোগান্তি নিরসনে প্রশাসন ও বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করা। হলভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনসাপেক্ষে ফার্মেসি স্থাপন করা।
২০। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জনা 'অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি' চালু করা।
২১। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করা। প্রত্যেক ভাষায় অন্তত একজন বিদেশি শিক্ষক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া। ল্যাংগুয়েজ রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা।
২২। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ল্যাবগুলোতে উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা। সায়েন্স ওয়ার্কশপ, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন সায়েন্সেসের (সিএআরএস) এবং সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসের (সিএআরএএসএস) আধুনিকায়ন নিশ্চিত করা। গবেষণা সহায়ক সফটওয়্যার ও টুলসমূহের সহজলভাতা নিশ্চিত করা। বিশেষত, ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলোজির (আইএলইটি) ল্যাবে আধুনিক মেশিনারিজ ক্রয় করা মাধ্যমে ল্যাবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে চামড়া শিল্পে অবদান রাখার সুযোগ ক্ষেত্র বৃদ্ধি করা।
২৩। ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে বহিরাগত যান নিয়ন্ত্রণ, হকার ও ভবঘুরেদের উচ্ছেদ করা। ক্যাম্পাস এলাকায় রেজিস্ট্রার্ড রিকশা প্রবর্তন ও ভাড়া তালিকা প্রণয়ন করা।
২৪। যৌন হয়রানি ও সাইবার বুলিং প্রতিরোধে 'জিরো টলারেন্স নীতি' বাস্তবায়ন। যৌন নির্যাতন বিষয়ক অভিযোগ সেল শক্তিশালীকরণ ও আইনি সহায়তা প্রদান।
২৫। ক্যাম্পাসের অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোতে ফ্রি 'মেন্সট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ট' সহজলভ্য করা।
২৬। হলভিত্তিক সমস্যা সমাধানে 'গ্রিভেন্স রেসপন্স টিম' গঠন করা এবং ক্যাম্পাস অমবুডসপারসন নিয়োগ করা। নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করা ও ভিক্টিমদের সহায়তার জন্য 'ভিক্টিম সাপোর্ট সেল' গঠন।
২৭। বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত মেইলের অ্যাক্সেসিবিলিটি বাড়ানো। ই-মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন জার্নাল, সাময়িকী ও ওয়েবসাইটে অ্যাক্সেস রাখা এবং বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক অ্যাপের প্রিমিয়াম অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা। অ্যালামনাইদের জন্য অফিসিয়াল ই-মেইলের ব্যবস্থা করা।
২৮। জরাজীর্ণ বাসগুলো বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাবস্থাপনায় নতুন বাস ক্রয় করা। মোবাইল অ্যাপে রিয়েলটাইম ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করা। বাসের সংখ্যা ও ট্রিপ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন রুট বৃদ্ধি করা। অভ্যন্তরীণ পরিবহন বাবস্থা উন্নয়নের জন্য শাটল চালু করা।
২৯। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে সারা দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে 'লিগ্যাল হেল্প ডেস্ক' স্থাপন করা।
৩০। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের অবকাঠামোগত আধুনিকায়ন, এক্সপার্ট কিউরেটরের মাধ্যমে মাঠ পরিচর্যা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা। হলপর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকায়ন ও ইনডোর গেমসের আওতা বাড়ানো।
৩১। টিএসসির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। টিএসসির নিকটবর্তী ছাত্রী হল ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অবস্থান বিবেচনায় সাইন্ডবক্স ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন।
৩২। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী উপযোগী ক্লাসরুম ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা। তাদের জন্য ওয়াশরুমে বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
৩৩। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য 'সেলফ ডিফেন্স প্রশিক্ষণ' আয়োজন করা।
৩৪। হলগুলোতে কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং কর্মচারী মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা।
৩৫। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সংরক্ষণ, শব্দ দূষণ রোধ, সুষ্ঠু ট্র্যাফিক বাবস্থা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন গ্রিন ক্যাম্পাস গঠন করা। ক্যাম্পাসের পরিচ্ছন্নতা রক্ষার্থে প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা।
৩৬। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলায় এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করা।