চলনবিল ভরাট করে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস: বিকল্প স্থানের দাবি পরিবেশবিদদের

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস একনেক অনুমোদিত চলনবিল এলাকায় নয়, বরং প্রয়োজন হলে নতুন জমি অধিগ্রহণ করে শাহজাদপুরের অন্য কোথাও নির্মাণ করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ১৭ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। তবে এতে শর্ত দেওয়া হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়া সাপেক্ষে কাজ শুরু করতে হবে। প্রায় ৫১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৫ সালের মে থেকে ২০২৯ সালের এপ্রিল মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত স্থান চলনবিলে হওয়ায় পরিবেশবিদরা এর বিরোধিতা করেছেন।
বিশেষজ্ঞ ও চলনবিল রক্ষার পক্ষে থাকা সংগঠনগুলো সিরাজগঞ্জ অর্থনীতি অঞ্চল এবং শাহজাদপুরের একাডেমিক ভবন-৩–এর বিপরীতে আরও তিনটি বিকল্প জমির প্রস্তাব দিলেও সরকার সে পথে যায়নি।
২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে পৌর শহরে ভাড়া করা ৮টি ভবনে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১,২০০। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে শাহজাদপুরের বুড়ি পোতাজিয়ার চলনবিল এলাকায় ১০০ একর জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
গত ১৬ জুন প্রস্তাবিত স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তার পরিদর্শনের পর জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই জমি বছরে চার মাস পানির নিচে থাকে, যা ৯ মিটারের বেশি ভরাট করতে হবে। আর এরজন্য দরকার হবে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৬৩০ ঘনমিটার বালু। ক্যাম্পাসে প্রবেশের জন্য নির্মাণ করতে হবে সড়ক ও সেতু, পাশাপাশি ঢেউ প্রতিরোধেও দিতে হবে বাঁধ। আর এসব কাজে ব্যয় হবে প্রায় ৪৪৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ইতোমধ্যে চার একর ভরাট করায় বড়াল নদের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাকি ৯৬ একর ভরাট করা হলে বর্ষাকালে চলনবিল ও বড়াল নদের পানিপ্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চলনবিল অঞ্চলজুড়ে ছয়টি জেলা, ৪১টি উপজেলা, এক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪৭টি নদী, ১৬৩টি বিল, ৩০০-এর বেশি খাল ও এক লাখ ২০ হাজার পুকুর রয়েছে। এ অঞ্চলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুড়ি পোতাজিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলে চলনবিল, গোহালা ও বড়াল নদীর মুখে পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এবং উজান থেকে নামা ৪৮টি নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিকল্প সমাধান কী?
পরিবেশবিদদের মতে, প্রস্তাবিত চলনবিল এলাকায় নয়, শাহজাদপুরের অন্য কোনো জায়গায়—প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে—রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করা যেতে পারে।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক এস এম মিজানুর রহমান বলেন, "অপরিকল্পিত উন্নয়নে এমনিতেই অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে চলনবিল। এর কোলঘেঁষে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে সেটি কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো হবে। এতে অন্য দখলদাররাও বৈধতা পেয়ে যাবে।"
তিনি আরও বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় এই অঞ্চলে হোক—আমরা তার বিরোধী নই। তবে সেটি অবশ্যই প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করে হতে হবে। আমরা চলনবিলকে বাঁচাতে চাই।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, "বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুকনা মৌসুমে প্রস্তাবিত স্থান দেখিয়ে অনুমোদন নিতে চেয়েছিল। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, স্থানটি পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য উপযুক্ত নয়।"
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "একনেকে অনুমোদন হলেও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হবে।"
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমরা শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেয়েছে, তবে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র হাতে পাইনি। ১০০ একর জমি সরকারই নির্ধারণ করেছে, আমরা এই সাইট চেয়ে আবেদন করিনি। আমাদের প্রয়োজন একটি উপযুক্ত স্থান, যেখানে পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস নির্মাণ করা সম্ভব। আমরা চাই স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ দেরি না করে শুরু হোক।"