আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বারবার পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছিল: ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে প্রথম নিহত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বারবার পরিবর্তন করতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজের (রমেক) ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রাজিবুল ইসলাম।
রবিবার (২৪ আগস্ট) শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের সাক্ষ্য চলাকালে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি এই কথা বলেন।
এছাড়াও সরকারের ইচ্ছামতো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করার বিনিময়ে সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ড ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন ডা. রাজিবুল ইসলাম।
গত বছর কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ওই আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৎকালীন প্রানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
ডা. রাজিবুল ইসলাম জবানবন্দিতে বলেন, '২০২৪ সালের ১৬ জুলাই তিনি আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন। যথানিয়মে ময়নাতদন্ত শেষে তিনি প্রতিবেদনে আবু সাঈদের শরীরে পিলেট পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। অনেকগুলো পিলেট বিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্ষক্ষরণে তার মৃত্যু হয় বলে প্রতিবেদনে লেখেন।'
তিনি বলেন, 'আমি মতামত দেই এই মৃত্যু হোমিসাইডাল ইন-নেচার। এই ঘটনায় রংপুরের তাজহাট থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে এই রিপোর্ট জমা দিতে গেলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর আমার রিপোর্ট গ্রহণ না করে পুনরায় রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন।'
ডা. রাজিবুল বলেন, 'একই রিপোর্ট সামান্য এদিক-ওদিক করে তিনি আবার জমা দেন। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তার রিপোর্ট জমা নেওয়া হয়নি।'
এরপর তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজের (রমেক) উপাধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'সেখানে ছিলেন প্রিন্সিপাল ডা. মাহফুজুর রহমান, সিটি এসবি এসপি সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ এবং স্বাচিপের রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) শাখার সভাপতি ডা. চন্দন। তারা আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন। ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা বাইরে অবস্থান করছিলেন।'
তারা তাদের কথামতো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে চাপ দিচ্ছিলেন এবং ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন বলে দাবি করেন ডা. রাজিবুল।
তিনি বলেন, 'তারা বলেন আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, মামলা হবে। আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে। পরে প্রলোভন দেখান- আপনি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসেন। আমি বলি যে আমার পাসপোর্ট নেই। তখন তারা বলেন যে তাহলে কক্সবাজার যান দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে।'
সাক্ষ্যে ডা. রাজিবুল বলেন, 'তারা বারবার বলছিলেন যেন মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। তখন আমি ভাইস প্রিন্সিপালকে বলি, স্যার আবু সাঈদের মৃত্যু যে গুলিতে হয়েছে তা পৃথিবীর সব মানুষ দেখেছে, মিডিয়াতে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি যদি এখন লিখি যে মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে, তাহলে সারাবিশ্বের লোক ডাক্তার সমাজকে ঘৃণা করবে।'
তিনি বলেন, 'তখন স্বাচিবের রংপুর মেডিকেলের সভাপতি চন্দন স্যার বলেন আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে চায়, সেভাবে রিপোর্ট দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখব।'
নেত্রী বলতে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন বলে জানান রাজিবুল।
আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী এই চিকিৎসক জানান, চতুর্থবারের প্রতিবেদনে ইনজুরির কথা ঠিক রাখলেও তিনি বন্দুকের কথা উল্লেখ করেননি এবং মতামতেও মাথায় আঘাতের কথা রাখেননি।
তিনি বলেন, 'ফাইনালি দেওয়া রিপোর্টে ইনজুরির বর্ণনা ঠিক রাখলেও এগুলো যে গান বুলেট সে কথা রাখিনি। পিলেটের কথা উল্লেখ ছিল। রিপোর্টের নিচে মতামতে লিখি উল্লেখিত আঘাতজনিত কারণে শরীরে শক ও রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে, যেগুলো জীবিত অবস্থায় (অ্যান্টিমর্টেম) ঘটেছিল এবং এই মৃত্যু হোমিসাইডাল ইন-নেচার। অনুগ্রহ করে সার্কামসটেনশিয়াল এভিডেন্স (পরিস্থিতিগত প্রমাণ) বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।'
ডা. রাজিবুল জানান, 'এরপর প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়, এটি ছিল পঞ্চম প্রতিবেদন। মাঝে একটি প্রতিবেদন পুলিশ ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তিনি সরিয়ে রাখায় পুলিশ তা করতে পারেনি।'
আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের সেই সময়ের কথা বলতে বলতে রাজিবুল একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন।
ময়নাতদন্তকারী এ চিকিৎসক কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপের পেনড্রাইভ জমা দেন, যা ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়।