বেহাল মহাসড়ক: বন্দর-বাণিজ্যে স্থবিরতা, পর্যটনে সীমাহীন দুর্ভোগ
খুলনা, সাতক্ষীরা, কিংবা সিলেট—দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মহাসড়ক যেন এখন মৃত্যুফাঁদ। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বা সংস্কার করা এসব সড়ক নিম্নমানের কাজ, দুর্নীতি এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে মোংলা, বেনাপোলসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের বাণিজ্য স্থবির হওয়ার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও নেমে এসেছে বিপর্যয়। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে জনদুর্ভোগ। যদিও সড়ক বিভাগ অতিরিক্ত যানবাহনের চাপকে দায়ী করে সংস্কারের আশ্বাস দিচ্ছে, ভুক্তভোগীরা এর পেছনে দুর্নীতিকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন।
খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক: পাঁচ বছরেই ধ্বংস ১৬০ কোটির প্রকল্প
পাঁচ বছর আগে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নির্মিত খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের অবস্থা এখন বেহাল। বিশেষ করে, জিরো পয়েন্ট থেকে কৈয়া পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার অংশে বিটুমিন উঠে গিয়ে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। কোথাও সড়ক ডেবে গেছে, কোথাও পিচ জমে ঢিবির আকার নিয়েছে। ভোমরা ও বেনাপোল বন্দর থেকে পণ্যবাহী হাজারো যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যেই সড়ক নষ্ট হতে শুরু করে।
খুলনা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, 'শুরু থেকেই এই সড়কের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখন প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক নির্মাণে দুর্নীতির দায় যারা নিয়েছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।'

তবে সওজ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তানিমুল হক বলেন, 'সড়কটি পুনর্নির্মাণের পর যানবাহন চলাচলের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আসা পাথর ও অন্যান্য পণ্য এই সড়কের ওপর দিয়ে ঢাকায় নেওয়া হয়। অতিরিক্ত চাপের কারণে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
যশোর-খুলনা মহাসড়ক: খানাখন্দে স্থবির বন্দরের বাণিজ্য
দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম যশোর-খুলনা মহাসড়ক। কিন্তু এর বসুন্দিয়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার অংশ টানা বর্ষণে গর্ত ও কাদায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
২০১৭ সালে ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হওয়া এই মহাসড়কের সম্প্রসারণ কাজ কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালে শেষ হয়। এরপর নতুন করে আরও ১৭২ কোটি টাকার কাজ চলমান থাকলেও চালুর কয়েকমাসের মধ্যেই সড়কের বিভিন্ন অংশ ভাঙতে শুরু করে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সবুর বলেন, '৩-৪ বছর ধরে এখানে সংস্কার কাজ চলছে। কিন্তু একদিকে কাজ শেষ না হতেই অন্যদিকে আবার রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে রোগী—সবাই কষ্ট পাচ্ছে। আমরা দ্রুত স্থায়ী সমাধান চাই।'
এই সড়কে নিয়মিত যাতায়াত করেন ট্রাকচালক রাজিব হোসেন। তিনি বলেন, 'চেঙ্গুটিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত অংশে গাড়ি নিয়ে চলা মুশকিল। প্রতিদিন গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে, দুর্ঘটনা ঘটছে। কখনো জ্যামে দুই-তিন দিন আটকে থাকতে হয়।'
আরেক চালক জালাল উদ্দিন জানান, 'আমার ট্রাকের স্প্রিং ভেঙে কাদায় আটকে পড়েছিল। পরদিন দুপুর পর্যন্ত সরানো যায়নি। আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।'
সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়ক: ২৫ বছরের অবহেলায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বড় ধরনের কোনো সংস্কার না হওয়ায় সাতক্ষীরা-শ্যামনগর মহাসড়কটি এখন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের পুরোটাই খানাখন্দে ভরা, যা বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকায় জনদুর্ভোগকে আরও চরমে তুলেছে।
সড়ক বিভাগ জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও স্থায়ী সমাধানের জন্য বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে শুরু হয়ে সুন্দরবন উপকূলের ভেটখালি পর্যন্ত পুরো সড়কটিই ভাঙাচোরা। সড়কের মাঝে সৃষ্টি হওয়া বড় বড় গর্তে যানবাহন আটকে যাওয়া এবং যন্ত্রাংশ বিকল হওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এই সড়কে বাস চালান আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, 'ভাঙা সড়কের কারণে বাসের ইজ্ঞিনসহ নানা ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। গেল ৩-৪ বছর ধরে সড়কটির এমন বেহাল দশা থাকলেও মেরামতের কোন উদ্যোগ আমরা দেখছি না।'
সাধারণ মানুষও এই পরিস্থিতি নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ। দেবহাটা এলাকার বাসিন্দা রাশেদুজ্জামান বলেন, 'হেঁটেও চলাচল করার মত পরিস্থিতি নেই সড়কটিতে। গর্তে পানি থাকায় একটি গাড়ি গেলে সেই পানি ছিটকে গায়ে পড়ে জামাকাপড় নষ্ট হয়ে যায়।'
উপকূলীয় শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার লাখো মানুষের জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম এই সড়ক। এছাড়া রাজধানী থেকে সুন্দরবনগামী দূরপাল্লার যানবাহনও এই পথেই চলাচল করে।

শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সড়কটি দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ চলাচল করছে অথচ কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে না। রাস্তা খারাপ থাকার কারণে সুন্দরবনের পর্যটকও কমে গেছে। আমাদের দূর্ভোগ দেখার কেউ নেই।'
সম্প্রতি সাতক্ষীরা সফরে এসে সড়কের এই বেহাল দশা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া। তিনি বলেন, 'পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন ছিল গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক। গোপালগঞ্জ উন্নয়ন হলেও আশপাশের জেলায় উন্নয়ন হয়নি।' তিনি সাতক্ষীরার সড়কের দুর্ভোগ কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।
সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জেলায় তাদের আওতাধীন ২৯০ কিলোমিটার সড়কের কমবেশি সবই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাতক্ষীরা-ভেটখালি সড়কের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ বলেন, 'সাতক্ষীরা থেকে ভেটখালি পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার সড়কে মানুষ দূর্ভোগে রয়েছে। ছয়টি প্যাকেজে আমাদের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল। পাঁচটি ইতোমধ্যে টেন্ডার শেষ হয়েছে, কার্যাদেশও প্রদান করা হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলেই সড়ক মেরামতের কাজ শুরু হবে। এছাড়া একটি প্যাকেজের কার্যক্রমও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সবমিলে সড়কটিতে ৫৭০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হবে।'
কাজ শেষ হলে মানুষের দূর্ভোগ থাকবে না বলে জানান এই কর্মকর্তা।
সিলেটের সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক: দেড় বছরেও শেষ হয়নি ৬ মাসের কাজ
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দি ও পান্থুমাই যাওয়ার প্রধান সড়ক সালুটিকর-গোয়াইনঘাটের অবস্থাও শোচনীয়। ২০২৪ সালে ১০ কিলোমিটার সড়কের সংস্কার কাজ শুরু হয়, যা ছয় মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এবং তিনবার মেয়াদ বাড়ানোর পরেও প্রকল্পের মাত্র অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়াও নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার এবং নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই সড়কে ভাঙন—এমন সব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঠিকাদার বন্যার অজুহাত দিলেও কর্তৃপক্ষ এখন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়কের বেশিরভাগ অংশ ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে পরিপূর্ণ। বন্যা, ভারী বর্ষণ ও যানবাহনের চাপে বছরের পর বছর ধরে সড়কটির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এতে বিছনাকান্দি ও পান্থুমাইয়ের মতো জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে যাতায়াতকারী পর্যটকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থী, রোগীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অল্প বৃষ্টিতেই সড়কটি যানবাহন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং প্রতিনিয়ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
এই অচলাবস্থা নিরসনে ২০২৪ সালে দুটি প্যাকেজে ১০ কিলোমিটার সড়কের সংস্কার ও নির্মাণকাজ শুরু হয়। ঢালি কনস্ট্রাকশন ও দেলোয়ার হোসেন কনস্ট্রাকশন নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। ছয় মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। কাজের নির্ধারিত সময় শেষে তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত করা হয়েছে।
উপজেলা প্রকৌশলী জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যদিও স্থানীয়দের দাবি, কাজের পরিমাণ ৩০ শতাংশেরও কম এবং অনেক স্থানে নতুন ঢালাই করা অংশও ভেঙে গেছে।
কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার এবং ঢালাই করা অংশ ভেঙে যাওয়ার মতো অভিযোগ পেয়ে বৃহস্পতিবার সড়কটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দুদক। অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পান দুদক কর্মকর্তারা।

দুদকের সিলেট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, 'সড়কের কাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। আরসিসি ঢালাই শেষ হওয়ার আগেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমরা পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছি। অনিয়মের প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হবে।'
তবে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, 'বন্যার কারণে সড়কের কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে।'
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সিলেট কার্যালয়ের প্রকৌশলী এ. কে শহীদুল ইসলাম বলেন, 'কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা তা আমলে নেয়নি। এখন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'