৮ মাস ধরে ওষুধ নেই যশোরের ২৮৩ কমিউনিটি ক্লিনিকে, বিপাকে দরিদ্র রোগীরা

যশোরে গ্রামীণ পর্যায়ে ২৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। দরিদ্র রোগীরা যাতে বিনা খরচে চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ পেতে পারেন সেজন্য এসব ক্লিনিক স্থাপন করে সরকার। কিন্তু গত ৮ মাস ধরে এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে নেই ওষুধের সরবরাহ। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন দরিদ্র রোগীরা।
সম্প্রতি মনিরামপুর উপজেলার পলাশী পূর্বপাড়ার ভ্যানচালক মিজানুর রহমান জ্বর ও ব্যথা নিয়ে বাসুদেবপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে যান। কিন্তু সেখানকার কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) তাকে জানান, ক্লিনিকে কোনো ওষুধ নেই। তিনি তাকে স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
ক্লিনিকের সামনে হতাশ কণ্ঠে মিজানুর রহমান বলেন, 'চার দিন ধরে জ্বর ও গায়ে ব্যথা। জ্বরের কারণে ভ্যান চালাতে পারছিলাম না। তাই এসেছিলাম কমিউনিটি ক্লিনিকে; কিন্তু কোনো ওষুধ দেয়নি। আমাদের মতো গরিব খেটে খাওয়া মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল এটা। সরকার ওষুধ দিতে না পারলে এসব খুলে রেখেছে কেন?'
বাসুদেবপুর ক্লিনিক থেকে গতকাল রোববার অন্তত ২০ জন রোগীকে ওষুধ না পেয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে।
শুধু বাসুদেবপুর নয়, যশোরের সব কমিউনিটি ক্লিনিকেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ওষুধ সংকট চলছে। সম্প্রতি এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে ও ভোগান্তিতে পড়ছে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
নেবুগাতী এলাকার কমলা বিশ্বাস বলেন, 'বাড়িতে পানি উঠে হাত-পায়ে চুলকাচ্ছে। ক্লিনিকে ওষুধ নিতে আইছি; কিন্তু বলল ওষুধ নাই।'
একইভাবে, বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের রফিকুল বিশ্বাস জানান, তিনি সম্প্রতি স্টোকে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে আছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকে গেলে সেখানে কোনো ওষুধ দিচ্ছেনা। এতে করে তার মতো দরিদ্র রোগীরা চরম বিপাকে পড়েছেন।
জেলা সিভিল সার্জনের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আগে তিন মাস পরপর ক্লিনিকে ওষুধ আসত। স্থানীয়দের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে প্রতি ক্লিনিকে দুই-তিন কার্টন ওষুধ সরবরাহ করা হতো। এখন তিন থেকে চার মাস ধরে কোনো ক্লিনিকে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে না।
প্রয়োজনীয় ওষুধ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ক্লিনিকগুলোর দায়িত্বে থাকা সিএইচসিপিরাও।
রোহিতার সিএইচসিপি দেবব্রত সরকার বলেন, '২৭ এপ্রিল আয়রন, জিংক, বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, প্রেশারের ওষুধসহ ২২ ধরনের ওষুধের একটি কার্টন পাইছি। চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে তা দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। আগে প্রয়োজন অনুযায়ী তিন কার্টন পেতাম। এখন ওষুধ দিতে পারি না। রোগীরা এসে জ্বর, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, ব্যথা, সর্দি, কাশি, চুলকানি, দাদ, অ্যালার্জি, ক্যালসিয়ামের ওষুধ চায়। আগে দৈনিক ৪০ জন রোগী আসত। এখন ওষুধ না থাকার খবর জানতে পেরে রোগী আসে না।'
একই সমস্যার কথা জানান নেবুগাতী এলাকার সিএইচসিপি মিঠু বিশ্বাসও। তিনি বলেন, 'গত বছরের মাঝামাঝি ওষুধ পাইছি। এরপর আর আসেনি। পুরোনো ওষুধ দিয়ে কোনো রকমে চালাচ্ছি। ওষুধ না দিতে পারলে পরামর্শ দিয়ে বিদায় দিচ্ছি।'
নাম প্রকাশ না করে এক স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, 'অনেক দিন ধরে ওষুধ নেই। রোগীরা এসে গালমন্দ করেন, বিষয়টি খারাপ লাগে। আমরা উপজেলার কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। তারা বলেছেন, যা আছে সেটা দিয়েই চিকিৎসা দেন। না থাকলে পরামর্শ দেন।'
এ বিষয়ে মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফাইয়াজ আহমেদ ফয়সাল বলেন, 'কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে বেশ কিছুদিন ধরে ওষুধের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। গত এপ্রিলে কিছু ওষুধ সরবরাহ দিতে পেরেছি। এরপর আর ওষুধ আসেনি। ওষুধ না পাওয়া পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
যোগাযোগ করা হলে জেলা সিভিল সার্জন মাসুদ রানা বলেন, 'আট মাস ধরে ওষুধের সংকট। আমরা প্রতি মাসেই চাহিদা পাঠাচ্ছি। তবে আসছে তিন ভাগের এক ভাগ। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে, জনগণ খালি হাতে ফিরছে—এটা সত্যি। তবে আগামী মাস থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে বলে ধারণা করছি।'