পাঁচই অগাস্টের পরে ওর সাথে আমার দেখা হয় নাই: চাঁদাবাজির অভিযোগকারীর বিষয়ে আসিফ মাহমুদ

"পাঁচই অগাস্ট ২০২৪-এর পরে ওর সাথে আমার কখনো দেখা হয় নাই, কথাও হয় নাই এবং রিয়াদ নামে আরেকজনের কথা যে বলা হচ্ছে, তাকে আমি চিনি না এবং ওরও আমাকে চেনার কথা না। কারণ আমাদের কখনো দেখা হয় নাই"–– কথাগুলো বিবিসি বাংলাকে বলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
ঢাকার গুলশানে ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপির বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ধারণ করা একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার প্রেক্ষাপটে এ মন্তব্য করেন তিনি।
ওই ভিডিওতে গুলশানে চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপুকে উপদেষ্টা আসিফের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করতে দেখা যায়।
তবে এমন কোনো ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। তার দাবি পূর্ব পরিচয় থাকলেও ২০২৪ সালের অগাস্টের পর জানে আলম অপুর সাথে তার আর কখনোই দেখা হয়নি।
এদিকে ওই ভিডিও ফাঁসের পেছনে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন জড়িত বলে অভিযোগ তুলেছেন জানে আলম অপুর স্ত্রী কাজী আনিশা।
বৃহস্পতিবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে সকাল ১১টার দিকে করা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি দাবি করেন, গ্রেফতারের আগে ৩১শে জুলাই রাত সাড়ে ১১টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপু নিখোঁজ ছিলেন।
এসময় তাকে জোর করে তুলে নিয়ে নিজ বাসায় ভিডিওটি করতে বাধ্য করেন ইশরাক, দাবি করেন মিজ আনিশা।
"অপুকে ইউজ করে একটা দল নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে এবং কাউকে দাবানোর জন্য" ১৪ দিন পর এসে ওই ভিডিও প্রকাশ করেছে বলেও তিনি দাবি করেন।
এবিষয়ে জানতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
কী আছে সেই ভিডিওতে?
বুধবার রাতে ৩৫ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে।
এতে কথা বলতে দেখা যায় গুলশানে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) বহিষ্কৃত নেতা জানে আলম অপুকে।
দীর্ঘ এই ভিডিওতে কেন ও কীভাবে তিনি গুলশানের ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন আর তারপর তার ভাষায় 'ফেঁসে গিয়েছিলেন'–– সে বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায় তাকে।
ভিডিওর অপর প্রান্ত থেকে এ সময় কাউকে প্রশ্নও করতে শোনা যায়।
এতে বলা হয়, গ্রেফতারের আগেই ভিডিওটি ধারণ করে অপু তার বন্ধুর কাছে এটি দিয়ে যান যেন পরে তার বক্তব্য সবার সামনে আসতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে তার স্ত্রী আনিশাও দাবি করেন, গ্রেফতারের আগের দিন রাতের বেলা ভিডিওটি করা হয়।
তবে "কোনো বন্ধুকে দেওয়ার জন্য না, বরং চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ভিডিওটি করানো হয়" বলে দাবি করেন তিনি।
তবে বক্তব্যটি ঠিক কখন ও কোথায় ধারণ করা হয়েছে বিবিসি তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
ভিডিওতে অপুকে বলতে শোনা যায়, ১৬ জুলাই রাত পেরিয়ে ১৭ তারিখ ভোর চারটা ১০ থেকে ৪০ মিনিট–– এই আধাঘণ্টার মধ্যে গুলশান ২ পার হয়ে ওয়েস্টিন হোটেলের নিচে সাদা সিএফমোটো বাইকে হেলমেট পরা অবস্থায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার সঙ্গে কথা বলেন।
তার বলা এই কথাগুলোর ওপর দিয়ে চলতে থাকে একই তারিখের রাত চারটা ১০ থেকে ১১ মিনিটের একটি সিসিটিভি ফুটেজ। সেখানে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা হয় একটি অংশ। এরপরই একটি বাইককে সেখান থেকে চলে যেতে দেখা যায়।
রাতে যে ভাই আসছে শুধু সেই ভাই না, "সব ভাইরাই এতে জড়িত" দাবি করে অপু বলেন, "এটা ওপেন সিক্রেট"।
"এটা চোখের সামনে আপনাদের, কে কী করছে। আঙুল ফুলে কলা গাছ কীভাবে হইছে। যেসব ছেলেপেলেরা হলে থাকতে পারতো না ছাত্রলীগের যন্ত্রণায়, বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে সেই টাকা থাকতো না, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের থেকে টাকা ধার নিয়ে থাকতে হতো, ডোনেশনে যাদের মেস ভাড়া চলছে, তারা এখন ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকে। নিজস্ব গাড়িতে চলাফেরা করে"- অপুকে বলতে শোনা যায়।
যদিও অপুর স্ত্রী দাবি করেছেন, ৩১ তারিখ রাতে বাইকে করে জোর করে অপুকে রাজধানীর গোপীবাগে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আনিশা দাবি করেন, ওই বাসাতেই অপুর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন ইশরাক। সেই আলাপের একটি স্ক্রিনশটসহ বাসার ভেতরের কিছু ছবি নিরাপত্তার স্বার্থে অপু তার স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে রাখেন।
অভিযোগের ব্যাপারে যা বলছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
২০২২ সালে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় থেকে জানে আলম অপুকে চেনেন বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
"কিন্তু পাঁচই অগাস্ট ২০২৪'র পরে ওর সাথে আমার কখনো দেখা হয় নাই, কথাও হয় নাই এবং রিয়াদ নামে আরেকজনের কথা যে বলা হচ্ছে, তাকে আমি চিনি না এবং ওরও আমাকে চেনার কথা না। কারণ আমাদের কখনো দেখা হয় নাই", বলেন তিনি।
একইসাথে সিসিটিভি ক্যামেরায় তাকে দেখা যাচ্ছে–– এমন কিছু পাননি বলেও মন্তব্য করেন এই উপদেষ্টা।
এদিকে আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মি.আসিফ বলেন, "আমি মাঝে মধ্যেই রাতে যখন কাজ শেষ হয়, কখনো কখনো ভোরও হয়ে যায়, ওই সময়ে আসলে রাতের খাওয়া-দাওয়া দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। আমি বেশিরভাগই যাই ৩০০ ফিটের নীলা মার্কেট বলে একটা জায়গায়। ওখানে হাসের মাংস খুব ভালো পাওয়া যায়।"
"তো ওখানে হয়তো যাই চার-পাঁচজন মিলে। ওটা আবার বেশি ভোর হয়ে গেলে বন্ধ থাকে। তখন ওদিকে ওয়েস্টিনে যাওয়া হয়। তবে এক্সাক্ট ওইদিন আমি গিয়েছিলাম কি না, সেখানে ছিলাম কি না এটা আমার মনে নাই।"
"সিসিটিভিতে যে কাউকে যদি আমি বলে দাবি করা হয় এটা আসলে কতটা বিশ্বাসযোগ্য আমি জানি না। এবিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। এটা তদন্তের অধীনে একটা বিষয়। তারপরও অনেক কিছু বললাম কারণ আমার নাম এসেছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "রাজনৈতিক নেতার বাসায় নেওয়ার যে অভিযোগ এসেছে এটা গুরুতর অভিযোগ। সেটা পরিবারের দিক থেকে এসেছে এবং যথেষ্ট রিলায়েবলও এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে। তো আমার সংশ্লিষ্টতার কথা বলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।"
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সামাজিক মাধ্যমে ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দিনই রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন জানে আলম অপুর স্ত্রী আনিশা।
তার দাবি, গ্রেফতারের পর রিমান্ড শেষে আটই অগাস্ট কাশিমপুর কারাগারে স্বামী অপুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তুলে নিয়ে জোর করে ভিডিও করার বিষয়ে আনিশাকে জানান তিনি।
আনিশার ভাষ্যমতে–– অপু বলেন, নিখোঁজ থাকার পুরোটা সময় সাদেক হোসেন খোকার গোপীবাগের বাসায় ছিলেন তিনি। সেখানেই চাপের মুখে ওই বক্তব্য ধারণ করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় এবিষয়গুলো গণমাধ্যম পর্যন্ত আনবেন তা তিনি জানতেন না।
গতকাল ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর "পাশ থেকে সরে যাওয়ারাই" তাকে খুঁজে বের করে সংবাদ সম্মেলন করার ব্যবস্থা করে দেন বলে দাবি করেন তিনি।
"আমার সামনে এতগুলা চ্যানেল দাঁড়ায় আছেন, আমি তো কাউকে চিনি না। এগুলা আমাকে ম্যানেজ করে দিছে অপুর দলের (লোকেরা), যখন অপুর এনসিপির ওপর প্রশ্ন আসলো, এনসিপির ওপরে প্রশ্ন চলে আসলো, এনসিপির স্বার্থে চলে আসলো, তখন তারা আমাকে এখানে নিয়ে আসছে," বলেন আনিশা।
ভিডিওটিতে কেউ একজন ক্যামেরার পেছন থেকে প্রশ্ন করেন অপুকে। সেই বিষয়টি উল্লেখ করে আনিশা বলেন, "৩১ তারিখ থেকে ১ তারিখ ওকে কে আটকে রাখছে? কে দফায় দফায় একটু একটু করে ভিডিও রেকর্ড করছে?"
কারা কোন পেজ থেকে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে তা খুঁজে বের করলেই ইশরাক হোসেনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানা যাবে বলেও দাবি করেন তিনি।
এমনকি ইশরাক হোসেনের বাসার সামনে থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও দাবি করেন মিজ আনিশা।
"আমার ধারণা, অপুকে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথা বলছিলো যে তুমি আমাকে আসিফ অথবা নাহিদ যেকোনো একটা উপদেষ্টার শুধু একটা নাম বলবা যে এরা তোমাদের দিয়ে চাঁদাবাজি করায়। তাইলেই হবে। তোমার যত রকমের হেল্প লাগে, আমরা তোমাকে করবো", সংবাদ সম্মেলনে বলেন তিনি।
ইশরাক হোসেনই ডিবিকে ফোন করে অপুকে ধরিয়ে দেন বলে দাবি করেন মিজ আনিশা। বলেন, রিমান্ডে নিয়েও আসিফ মাহমুদ আর নাহিদ ইসলামের নাম বলতে অপুকে চাপ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে জানে আলম অপু চাঁদাবাজির পেছনে তাদের কারও সম্পৃক্ততার কথা বলেননি বলেও দাবি করেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফোন ও ম্যাসেজের মাধ্যমে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন।