৮২ সংস্কারে ঐকমত্য নিয়ে চূড়ান্ত হচ্ছে জুলাই সনদের খসড়া, ৮ বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম ধাপে ৬২টি এবং দ্বিতীয় ধাপে ২০টি—মোট ৮২টি বিষয়ে সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে ৮টি বিষয়ে বিএনপি এবং সংবিধানের মূলনীতি ঘিরে বাম দলগুলো 'নোট অব ডিসেন্ট' (ভিন্নমত) দিয়েছে।
কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ আগস্ট পর্যন্ত থাকলেও, 'জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫'-এর চূড়ান্ত খসড়া দু-এক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সনদের দুটি অংশ থাকবে—এক অংশে থাকবে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, আরেক অংশে থাকবে দলগুলোর নিজ নিজ প্রতিশ্রুতির তালিকা।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "আমরা দ্রুত চূড়ান্ত সনদ প্রস্তুত করে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। এরপর স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনাও রয়েছে।"
সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, "প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক দলগুলো এই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে কীভাবে অগ্রসর হবে? এই বিষয়েও আলোচনা হবে।"
তিনি জানান, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কমিশনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে ২০টি বিষয়ে আলোচনা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩ দিনের সংলাপ শেষে ২০টি বিষয়ের মধ্যে ১১টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ঐকমত্য হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—চারটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার প্রস্তাব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে কমিটি গঠন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের বিধানে আইনি নির্ধারক সংযোজন ও সংশোধন এবং বিচার বিভাগের কাঠামোগত বিকেন্দ্রীকরণ।
এছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনা, মূলনীতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ কয়েকটি অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রস্তাবেও কোনো রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত উঠে আসেনি।
রাষ্ট্রপতির গোপন ব্যালটে নির্বাচনের পদ্ধতি এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বিত মত গঠিত হয়েছে।
সবশেষে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনার ব্যাপারেও সব দলের সম্মতি পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের পদ্ধতি, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা সংক্রান্ত প্রস্তাব।
এছাড়া, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নিয়ন্ত্রক ও মহা হিসাব নিরীক্ষক (সি অ্যান্ড এজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত করা, উচ্চকক্ষে পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতিতে নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ–এসব বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এসব বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ ও ১২ নম্বর ধারার বিপক্ষে বিএনপি 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্রপতির নিয়োগের ক্ষমতা
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি ছাড়া রাষ্ট্রপতির সব ধরনের সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি নিয়োগ ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল।
পরবর্তী আলোচনায় দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়—জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, আইন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে আর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভিন্নমত প্রকাশ করেছে।
সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ হলেও, 'জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫' বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। বিএনপির অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নির্ধারণে প্রয়োজন হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কমিশন আবারও আলোচনায় বসবে। আমরা বিশ্বাস করি, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে তারা নিজেরাই পথ তৈরি করবে। সেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।"
তিনি আরও বলেন, "যেকোনো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পথ চিহ্নিত করতে হবে। সে প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা রয়েছে। বাইরে থেকেও যেটুকু প্রয়োজন, তা করা হবে। এ নিয়ে শিগগিরই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে।"
'কোনো দল দুঃসাহস দেখাবে না এটা না মানার' — সালাহউদ্দিন আহমদ
শেষ দিনের আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, "জনগণের সার্বভৌম এখতিয়ার থেকেই আমরা এই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করছি। আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি। এর চেয়ে বড় জাতীয় ঐকমত্য আর হতে পারে না। এটা আইনের ঊর্ধ্বে—এটা জনগণের ইচ্ছা, এটা একপ্রকার সার্বভৌম প্রত্যয়।"
তিনি বলেন, "এই সনদে বলা আছে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে এসব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান যা পরিবর্তন দরকার, তা করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, "এই সনদে শুধু কমিশন নয়, সব রাজনৈতিক দল সই করবে। এটি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক। এটি জনগণের প্রত্যাশা। এটি আইনের চেয়েও বড়—এটি এক ধরনের লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন অব দ্য পিপল (জনগণের বৈধ প্রত্যাশা)।"
তিনি আরও বলেন, "এতো আলোচনার পর কেউ যদি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে তা জাতিকে ধোঁকা দেওয়ার শামিল হবে। আমি মনে করি না—এখানে এমন কোনো দল আছে যারা এমন করবে। কারণ, সবাই প্রকাশ্যে জাতীয় আলোচনায় অংশ নিয়েছে, জাতি দেখেছে। সনদে প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি জাতীয় নেতাদের স্বাক্ষর থাকবে, যা ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে।"
"এরপরেও কি কেউ দুঃসাহস দেখাবে এটা না মানার? আমার তো মনে হয় না। এর চেয়ে বড় কোনো সমঝোতা স্মারক বা দলিল হতে পারে না," যোগ করেন তিনি।
সনদ বাস্তবায়নে শক্তিশালী আইনি ভিত্তি চায় জামায়াত ও এনসিপি
'জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫' বাস্তবায়নে শক্তিশালী আইনি ভিত্তি দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এমনকি আইনি ভিত্তি না থাকলে কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণমূলক মামলা করার কথাও বলেছে জামায়াত।
শেষ দিনে দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, "বিএনপি বলছে সনদের আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু জামায়াত মনে করে, শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এজন্য আমরা কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করব।"
এর আগে, ৩০ জুলাই কমিশনের এক বৈঠকে জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, সনদের একটি আইনি কাঠামো বা 'লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার' নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই কার্যকর হতে হবে। তিনি বলেন, "প্রধান উপদেষ্টা গণভোট ও ঘোষণার (প্রক্লেমেশন) মাধ্যমে এই ভিত্তি তৈরি করতে পারেন।"
নায়েবে আমির তাহের বলেন, "শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণভোট ও ঘোষণার মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নিয়েছিলেন, পরে তা সংসদে অনুমোদনের (র্যাটিফিকেশন) মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। এরশাদের সময়েও একইভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।"
শিশির মনির বলেন, "জনগণের অভিপ্রায়ের চেয়ে বড় সাংবিধানিক ম্যান্ডেট আর কিছু হতে পারে না। তাই এই জনগণের অভিপ্রায়কে সাংবিধানিক ঘোষণার (প্রক্লেমেশন) মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।"
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, "জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনো অস্পষ্ট। এ নিয়ে কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বসা প্রয়োজন। যদি এটি সংসদ নির্বাচনের দুই বছরের মধ্যে কার্যকর না হয়, তাহলে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করব।"
তিনি বলেন, "আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদ শুধু একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই থেকে যাবে। এমন হলে আমরা সই করব না। কারণ, ভবিষ্যৎ সরকার এর স্বীকৃতি দেবে—এই কথা শুধু ফাঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।"
আখতার হোসেন আরও বলেন, "সরকার আন্তরিক হলে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করলে, ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ, আইনি ভিত্তিসম্পন্ন এবং সাংবিধানিক ঘোষণাপত্র জারি করা সম্ভব।"