রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও ‘ব্লক রেইড’ করা হয়: জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি এবং আন্দোলনপ্রবণ এলাকা ভাগ করে 'ব্লক রেইড' পরিচালনা করা হয়েছে বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তিনি বলেন, আন্দোলন দমনে সেসময় প্রতি রাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হয়েছে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় গত ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ জবানবন্দি দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, 'আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে একপর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনকে নজরদারি, গুলি করা ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গোপন পরিকল্পনা করা হয়। আমি পরে জানতে পারি র্যাবের ডিজি (মহাপরিচালক) হারুন অর রশিদের পরিকল্পনায় ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। তবে পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি উক্ত কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়।'
প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে পরবর্তীতে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ও আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে এলাকা ভাগ করে ব্লক রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আমার সামনে অতিরিক্ত ডিআইজি (হেডকোয়ার্টার) প্রলয় জোয়ারদার উপস্থিত ছিলেন। তার মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই নির্দেশনা জানতে পারেন।'
জবানবন্দিতে আরও বলা হয়েছে, 'ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন যেকোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। ১৮ জুলাই (২০২৪) ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চায়নিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দেন।'
সাবেক আইজিপি তার জবানবন্দিতে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনা দুই দফা বৈঠক করেন। বেলা ১১টায় গণভবনে শেখ হাসিনার প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান এবং আইজিপিসহ নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্যরা। এ বৈঠকে আন্দোলন পরিস্থিতি এবং তা দমনের উপায় নিয়ে আলোচনা হয়।
এরপর ৪ আগস্ট রাতে হঠাৎ শেখ হাসিনা গণভবনে বৈঠক ডাকেন জানিয়ে তিনি বলেন, সেই বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তার বোন শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি এবং আইজি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। ওই বৈঠকে কীভাবে ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে সাবেক আইজিপি তার জবানবন্দিতে বলেন, এই নির্বাচনের আগের রাতেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যালট বাক্স ভরে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল।
গুম ও গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে তিনি জানান, র্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা বা গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এ ধরনের আদেশ পাই নাই। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের পক্ষ থেকে আসত বলে জানতে পারি।'
২০২২ সাল থেকে হাসিনার সরকারের পতন পর্যন্ত চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন। তার আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
সাবেক এই আইজিপি গ্রেপ্তারের পর বর্তমানে কারাগারে আছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন।