জুলাই সনদের খসড়া: রাজনৈতিক দলগুলোকে ২ বছরের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে

সংস্কারের জন্য ঐকমত্যের বিষয় উল্লেখ ছাড়াই জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে দুই বছরের মধ্যে দলগুলোর কাছে সংস্কার কাজ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এই খসড়া নিয়ে কোনো পরামর্শ ও আপত্তি থাকলে কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫'-এর খসড়া সনদে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
প্রথমত, হাজারো মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে গৃহীত ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত এই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সনদে সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কারের যে সুপারিশ রয়েছে, তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও আইনগত সংশোধন, পুনর্লিখন এবং নতুন আইন ও বিধি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে।
তৃতীয়ত, এই সংস্কার প্রক্রিয়া আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করবে এবং তা টেকসই করতে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে অঙ্গীকার করা হয়েছে।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, 'আমরা সনদের খসড়া অংশগুলো পর্যালোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছি। চলমান সংলাপ শেষ হওয়ার পরে যে বিষয়গুলো (সম্মত সংস্কার সুপারিশ) নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো চূড়ান্ত সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই খসড়ায় বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুরের মধ্যে দলগুলোর সংযোজন বিয়োজন সাপেক্ষে আমরা পরবর্তী ধাপে যাবো।'
এর আগে আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২০তম দিনের বৈঠক শুরু হয়।
সাংবিধানিক সংস্থার সংস্কার নিয়ে আলোচনা
আজকের আলোচনার বিষয়ে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বসম্মত মত রয়েছে। তিনি জানান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে 'দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন'-এর পক্ষ থেকে দুদককে সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবটিকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। তবে আলোচনায় প্রস্তাবিত কাঠামোর কিছু সংশোধনের সুপারিশ এসেছে, পাশাপাশি কেউ কেউ নতুন প্রস্তাবও দিয়েছেন।
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)-এর বিষয়েও আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "পিএসসিকে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। প্রস্তাবিত কাঠামোতে কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ এসেছে।" তিনি জানান, কমিটি গঠনের বিষয়ে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত ও পরামর্শ পাওয়া গেছে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে 'ঐকমত্য কমিশন' ধাপে ধাপে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি আরও বলেন, নিয়োগসংক্রান্ত নীতিমালায় ভিন্নমত থাকলেও পিএসসিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও শক্তিশালী করার বিষয়ে দলগুলো একমত। একইভাবে, দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও বেশিরভাগ দল সম্মতি জানিয়েছে। তবে বিএনপি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটি মৌখিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে আগামীকাল আলোচনা হবে।
আলোচনায় থেকে বিএনপির ওয়াকআউট
এদিকে, বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রতিবাদস্বরূপ প্রায় ৩০ মিনিটের জন্য আলোচনা থেকে ওয়াকআউট করে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা কিছু সময়ের জন্য বৈঠক থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। কারণ আমরা আগেই স্পষ্ট করে বলেছি, কিছু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়োগ কমিটি গঠন করে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলে রাষ্ট্র ও সরকারের কার্যক্রমে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।"
তিনি বলেন, সংবিধানিক ও আইনি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
"জনগণের প্রত্যাশা পূরণ এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে নির্বাহী বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে, দুর্বল করা চলবে না," বলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
বিএনপির ওয়াকআউট প্রসঙ্গে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
তিনি জানান, কমিশনের অনুরোধে বিএনপি প্রতিনিধিদল আলোচনায় ফিরে আসায় তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে জামায়াতের নতুন প্রস্তাব
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কমিশনের মূল প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপির অবস্থানের মিল রয়েছে। তবে অন্যান্য দলের মতামতের সঙ্গে মিলিয়ে জামায়াত একটি মৌখিক প্রস্তাব দিয়েছে।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটিকে সর্বসম্মত হতে হবে। অথবা পাঁচ সদস্যের কমিটির ক্ষেত্রে চার-এক এবং সাত সদস্যের ক্ষেত্রে পাঁচ-দুই ভোটে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
র্যাংক চয়েস পদ্ধতিতে প্রকাশ্য ব্যালটের প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, এতে হর্স ট্রেডিংয়ের ঝুঁকি কমবে। এছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে যেন রাষ্ট্রপতিকে সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে রাখা না হয় এবং বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়।
তিনি জানান, রাতের মধ্যেই প্রস্তাবটি লিখিতভাবে কমিশনে জমা দেওয়া হবে।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "জামায়াত লিখিত প্রস্তাব দিলে তা আজ (২৮ জুলাই) রাতেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে এবং আগামীকাল (২৯ জুলাই) আলোচনায় তা উপস্থাপন করা হবে।