২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিশোধিত চিনির আমদানি বেড়ে দ্বিগুণ, শুল্ক কমায় সংকটে দেশীয় রিফাইনারিগুলো

সরকারি তথ্য ও শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, আমদানি শুল্ক কমানোর পর চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পরিশোধিত চিনির আমদানি এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের স্থানীয় চিনিশোধনাগারগুলো; তাদের কাঁচা চিনির আমদানি ২০ শতাংশের বেশি কমেছে বলে জানা গেছে।
২০২৪–২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিশোধিত চিনির আমদানি আগের বছরের তুলনায় ৯৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৩৮০ টনে, যেখানে আগের বছর এই পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮০ টন।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, পরিশোধিত চিনির আমদানি বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো আমদানি শুল্কে ছাড় এবং স্থানীয় বৃহৎ পরিশোধন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচা চিনির আমদানি কমে যাওয়া। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপ এবং দেশবন্ধু গ্রুপ। এছাড়া খাদ্য ও পানীয়, ওষুধ, দুগ্ধশিল্পের মতো খাতগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সরাসরি পরিশোধিত চিনি আমদানি করছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যালবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সাইকাত বলেন, 'কয়েক বছর ধরে আমরা স্থানীয় বাজার থেকেই চিনি সংগ্রহ করতাম। কিন্তু ২০২৫ সালের শুরু থেকে আমরা সরাসরি পরিশোধিত চিনি আমদানি শুরু করেছি, এবং দামও স্থানীয় বাজারের কাছাকাছি।'
মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, 'চিনির আমদানি বাড়ার অন্যতম কারণ হলো আমদানি শুল্ক হ্রাস।'
বর্তমানে পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টনপ্রতি ৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে, আর কাঁচা চিনির শুল্ক রয়েছে ৩ হাজার টাকা।
ফলস্বরূপ, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে পরিশোধিত চিনির আমদানির মোট মূল্য ৯৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যেখানে আগের বছর তা ছিল ১ হাজার ১১৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। এতে শুল্ক রাজস্বও ৫৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯২৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ৫৮৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
চ্যালেঞ্জে স্থানীয় পরিশোধন শিল্প
বাড়তি পরিশোধিত চিনি আমদানিতে দেশীয় চিনিশিল্প বিপাকে পড়েছে। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে গড়ে ২০ লাখ টনের মতো চিনির চাহিদা রয়েছে, যার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো—যেমন সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, টি কে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ এবং দেশবন্ধু গ্রুপ—মূলত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং ভারত থেকে কাঁচা চিনি এনে পরিশোধন করে বাজারজাত করে।
তবে এই কাঠামো এখন পরিবর্তনের পথে। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'আমাদের কাঁচা চিনির আমদানি এক বছরে প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে।' তিনি জানান, যেসব কোম্পানি উৎপাদন খাতে ব্যবহারের জন্য পরিশোধিত চিনি আমদানি করছে, তারা শুল্ক ছাড় পাচ্ছে, যা স্থানীয় পরিশোধনাগারগুলোর জন্য একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার ও মুখপাত্র সাইদুল ইসলাম বলেন, 'যে কোম্পানি উৎপাদনমুখী, তারা কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি পায়। খাদ্য, পানীয় ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও একই সুবিধা প্রযোজ্য।'
কমছে কাঁচা চিনির আমদানি
গত কয়েক বছর ধরেই কাঁচা চিনির আমদানি কমছে, যার পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বৃদ্ধি দায়ী। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম গ্রুপের কাঁচা চিনির আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দেশবন্ধু সুগার মিলও সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে, যা ফার্মা ও বেভারেজ কোম্পানিগুলোকে পরিশোধিত চিনি আমদানির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আবদুল মোনেম লিমিটেডের কমার্শিয়াল প্রধান আজিজ চৌধুরী বলেন, 'আগে আমরা বছরে প্রায় ৩ লাখ টন কাঁচা চিনি আমদানি করতাম। রিফাইন্ড চিনির ক্রেতা কমে যাওয়া এবং এলসি জটিলতার কারণে এখন তা কমে ২ লাখ টনে নেমে এসেছে।'
চিনির সামগ্রিক আমদানি প্রবণতা
সব বাধা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরে কাঁচা ও পরিশোধিত চিনির সম্মিলিত আমদানি বেড়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বন্দরে ১২ লাখ ১৭ হাজার টনের বেশি চিনি আমদানি হয়েছে, যার মূল্য ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং শুল্ক রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
এর আগের অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার টনের বেশি চিনি, যার মূল্য ছিল প্রায় ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং শুল্ক রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, চিনির মোট আমদানি ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশে বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দেশীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদন মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন, যা চাহিদার সামান্য অংশমাত্র। বাকি চাহিদা মেটানো হয় কাঁচা চিনি আমদানি করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর পরিশোধনের মাধ্যমে।