পাঁচ দশক পরও তৈরি হয়নি ইস্টার্ন রিফাইনারির ২য় ইউনিট, বাস্তবায়ন ব্যয় বেড়ে প্রায় ৩ গুণ

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে ব্যয়বহুল পরিশোধিত তেল আমদানির ওপর নির্ভরতা যেমন কমত, তেমনি প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ডলার সাশ্রয় হতে পারত। কিন্তু দেশের প্রথম ও একমাত্র শোধনাগারটি চালুর পাঁচ দশক পরও কেন এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি, সে প্রশ্ন এখনো থেকেই গেছে।
২০১০ সালে ইআরএল-২ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং ২০১৩ সালে সরকার প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন করে। কিন্তু প্রকল্পটি কোনো অগ্রগতি পায়নি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) স্ব-অর্থায়নে নতুনভাবে উদ্যোগ নিলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার কোটি টাকা, তবু কাজ শুরু হয়নি।
২০২৪ সালের শুরুতে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইআরএল-২ নির্মাণের আগ্রহ দেখালে ৯ জুলাই জ্বালানি বিভাগ প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। কিন্তু আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটায় প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিপিসি নতুন করে প্রকল্পটি সচল করার উদ্যোগ নেয়, তবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা।
বিপিসির তৈরি প্রাথমিক প্রকল্প প্রোফাইল অনুযায়ী, ইআরএল-২ বাস্তবায়িত হলে অপরিশোধিত তেল আমদানি খরচ কমার পাশাপাশি বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
আমদানিতে আগ্রহ বেশি
বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, ১৯৬৮ সালে প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার পরও বাংলাদেশ কেন দ্বিতীয় শোধনাগার নির্মাণ করতে পারেনি।
স্বাধীনতার আগেই নির্মিত এই শোধনাগার বছরে মাত্র ১.৫ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করতে পারে। অথচ দেশের বার্ষিক চাহিদা এখন ৭.৫ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। ফলে বাংলাদেশকে ব্যয়বহুল পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে, যা তুলনামূলকভাবে সস্তা অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের বিকল্পের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক ড. মুইনুল ইসলাম বলেন, 'পরিশোধিত তেল আমদানির কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করছে, অথচ সরকার কখনো ইআরএল-২ প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়নি।'
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশ প্রতিবছর ৭.৫ মিলিয়ন টন পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করছে, যেখানে ইস্টার্ন রিফাইনারি মাত্র ১.৫ মিলিয়ন টন পরিশোধন করতে পারে। আমাদের অন্তত ৬ মিলিয়ন টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন শোধনাগার দরকার ছিল। কিন্তু ৬০ বছর পার হলেও আমরা তা করতে পারিনি। এটি মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের প্রতিফলন।'
রাজনৈতিক প্রভাব ও ভূরাজনীতি
ড. ইসলাম মনে করেন, ভূরাজনৈতিক কারণেও ইআরএল-২ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, প্রথম ইউনিট নির্মাণকারী ফরাসি কোম্পানিকে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয় ভারতীয় পরামর্শক সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে।
তিনি বলেন, 'এখানে অনেক রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে, যার ফলে আমরা কখনো দ্বিতীয় ইউনিট পাইনি। এখন নতুন সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে কি না সেটাই প্রশ্ন।'
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম মনে করেন, অনেক আগেই বাংলাদেশে ইআরএল-২ নির্মাণের যথেষ্ট সুযোগ ছিল, যা বাস্তবায়িত হলে কম খরচে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত।
'ইআরএল-২ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেশের অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। এই ক্ষতি পূরণে দায়ীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত,' বলেন এ বিশেষজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা বাধা সৃষ্টি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। 'দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনাই একমাত্র উপায়।'
বিপিসির নতুন পরিকল্পনায় চ্যালেঞ্জ অর্থায়ন?
ইআরএল-২ নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদারের কাছ থেকে ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে, বাকিটা বহন করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
বৈদেশিক অর্থায়ন সহজ করতে পরিকল্পনা কমিশনের নীতিগত অনুমোদনের পর বিপিসি নতুন প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) জমা দিয়েছে।
প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে 'ইআরএল ইউনিট-২ ইনস্টলেশন' থেকে 'ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ (ইআরএল)' করা হয়েছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান জানুয়ারিতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরিশোধন খাতে বিনিয়োগকারী দেশ, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছ থেকে ঋণ বা ইকুইটি (মূলধন) সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা ঋণ নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। যদি ঋণ না পাই, তাহলে ইকুইটি বিনিয়োগের বিকল্প বিবেচনা করব। তবে নিশ্চিত করব যে বাংলাদেশের মালিকানা ৫১ শতাংশ বজায় থাকে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন ইআরডি কর্মকর্তা জানান, সৌদি জ্বালানি কোম্পানি আরামকো ইআরএল-২ নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে কোনো চুক্তি চূড়ান্ত করতে পারেনি।
সরকার বর্তমানে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ ও সংস্থার সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর এই আলোচনা আরও গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা
বিপিসি আমদানি নির্ভরতা কমাতে ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন সক্ষমতা ১.৫ মিলিয়ন টন থেকে ৪.৫ মিলিয়ন টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
ইআরএল-২ নির্মাণের মূল লক্ষ্য ব্যয়বহুল পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, এটি 'ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন' প্রকল্পের ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসেবে কাজ করবে।
এছাড়া, প্রকল্পটি ইউরো-৫ স্ট্যান্ডার্ড জ্বালানি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করবে, যা নির্গমন হ্রাস করে পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ও জ্বালানি দক্ষতা বাড়াবে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে পরিবহন খরচ কমবে, পণ্যের দাম হ্রাস পাবে এবং বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জ্বালানি আরও সাশ্রয়ী হবে।
চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি ১৯৬৮ সালে ফরাসি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান টেকনিপ-এর সহায়তায় নির্মিত হয়।
বর্তমানে, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বিপিসির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।