গোপালগঞ্জের সংঘর্ষে ৪৫ পুলিশ, সাংবাদিকসহ আহত অর্ধশতাধিক: পুলিশের প্রতিবেদন

এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র বুধবার গোপালগঞ্জের সংঘর্ষে ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) এ ঘটনায় পুলিশি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণ করতে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া মানুষের কথা শুনতে ১-৩০ শে জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে মাসব্যাপী 'দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা' কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ ই জুলাই 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' কর্মসূচিতে সকাল ১১টার দিকে গোপালগঞ্জ পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে এনসিপি তাদের জনসমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়।
এই সমাবেশে অংশ নেয়ার জন্য অনুমান সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল মহানগরীর সার্কিট হাউজ এলাকা থেকে দলের কেন্দ্রীয় নেতা জনাব নাহিদ ইসলাম, আহ্বায়ক-জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব আখতার হোসেন, সদস্য সচিব-জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব হাসনাত আবদুলাহ, মুখ্য সংগঠক-দক্ষিণাঞ্চল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক-উত্তরাঞ্চল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব শামান্তা শারমিন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব-জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব তাসনিম জারা, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব-জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, সিনিয়র মুখ্য সমন্বয়ক- জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনাব আরিফুল দাড়িয়াসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রওনা দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমাবেশের নিরাপত্তা জন্য সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকে। সকাল সাড়ে ৯টায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের একটি সন্ত্রাসী দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে আইনশৃঙ্খলা ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ ৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়।
এরপর সকাল ১১টার সময় গোপালগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় গোপালগঞ্জ ইএনও এর গাড়ি উক্ত স্থানে গেলে গাড়ি ভাঙচুর করে সড়ক অবরোধ করে রাখে।
সকাল সাড়ে ১১টায় কোটালীপাড়া থানার অবদার হাট এলাকায় কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম দারিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সার হাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ২,৮০০ থেকে ৩০০০ নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখে। সকাল ১১.৪০ ঘটিকার সময় গোপালগঞ্জ সদর থানার কাঠি বাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুন এর নেতৃত্বে ২০০-৩০০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ পৌরপার্ক সভাস্থলে পৌঁছানোর আগেই দুপুর আনুমানিক পৌনে ২টায় "জয় বাংলা" স্লোগান দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ৫০/৬০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণ করে ঢাল, দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মঞ্চে আক্রমণ করে। তারা মঞ্চের ব্যানার এবং চেয়ার ভাঙচুর করে। পরে দুপুর ২টার দিকে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মঞ্চে ওঠেন।
ইতোমধ্যে দুপুর সোয়া ২টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর থানার সাতপাড় বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নি সংযোগ করে। উচ্ছৃঙ্খল জনগণ রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে।
পুলিশ আরও জানিয়েছে, দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে পদযাত্রা সভা শেষ করে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সভাস্থল ত্যাগ করেন। এসময় সেখানে আনুমানিক ২০০ জন উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে তাদের গাড়িবহর পরবর্তী পদযাত্রা সভাস্থল মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরায় রওনা দিলে গোপালগঞ্জ পৌরসভার লঞ্চ ঘাটে আওয়ামী লীগ ও এর নিষিদ্ধ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনুমান বেলা ৩টায় তাদের গাড়িবহর আটকে দেয়।
এসময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ এনসিপির নেতা কর্মীদের উপর আক্রমণ করে। এছাড়া নাশকতাকারীরা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় হামলা করে। এসময় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। উক্ত ঘটনায় প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হয় মর্মে জানা যায়।
নাশকতাকারীদের আক্রমণের ফলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এনসিপি নেতাকর্মীদের পুলিশ সুপার এর কার্যালয়ে নিরাপদে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে বিকেল ৪টা ৫৮ মিনিটে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় এনসিপির নেতৃবৃন্দ গাড়িতে করে বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে চলে যান।
এছাড়া ওইদিন অনুমান সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত ৪ জনের মরদেহ পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়।
এসব হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায়, যৌথবাহিনী ও পুলিশ নাশকতার ঘটনার সাথে জড়িত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে । বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার্থে ১,৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে।
পুলিশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বর্তমান পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রয়েছে।