প্রশ্রয় না দিয়ে দেশে বিদ্বেষ-সহিংসতার বিস্তার থামান: সরকারকে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি

দেশে বিদ্বেষ-সহিংসতার বিস্তার, মব সন্ত্রাস, ধর্ষণ-খুনের দঙ্গল থামাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি
আজ শনিবার (১২ জুলাই) প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, 'বাংলাদেশে সহিংসতার একটি নতুন অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে, দেখা দিচ্ছে সংগঠিত 'দঙ্গলতন্ত্র'। তবে এই দঙ্গল এখন আর কেবল ধর্মীয় উগ্রতায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক বিরোধ, স্থানীয় আধিপত্য এবং এমনকি ব্যক্তিগত শত্রুতার মাটিতেও।'
বিবৃতিতে বলা হয়, যে 'সংঘবদ্ধ বিদ্বেষ' একসময় "ধর্ম অবমাননার" গুজবকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন কেড়ে নিত, এখন সেই একই কৌশলে সংগঠিত মব ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা ভিন্নমতের মানুষকে দমন করতে। কেউ কিছু বললেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে "নাস্তিক", "শাতিম" বা "বেইমান" বলে, তারপর তাকে ঘিরে সাজানো হচ্ছে দাঙ্গার মঞ্চ।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির দাবি, আজকের বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতা আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; এটি একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ-অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ। কখনো মসজিদের ভেতর খতিবকে কুপিয়ে ফেলা হচ্ছে, কখনো ব্যবসায়িকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, আবার কখনো মানুষের কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে 'শাতিম' তকমা দিয়ে।
ঘটনা ভিন্ন হলেও কৌশল এক—তকমা দাও, লোক 'জড়ো' করো, তারপর "শাস্তি" দাও। রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংগঠনটি। তাদের অভিযোগ, 'রাষ্ট্র কখনো নিষ্ক্রিয়, কখনো উদাসীন, আবার কখনো অপরাধীদের নীরব প্রশ্রয়দাতা। ২৪ এর গণ-অভ্যুন্থানের পরেও এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।'
বিবৃতিতে চাঁদপুরের একটি মসজিদে ইমাম নূর রহমান মাদানীর ওপর চাপাতি দিয়ে হামলার ঘটনাও তুলে ধরা হয়। হামলাকারী দাবি করেছে, ওই ইমাম নাকি নবী (সা.)-কে "অপমান" করেছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—কে অপমান নির্ধারণ করেছে, কোন আদালতে, কোন আইনে? সংগঠনের বক্তব্য, হামলাকারী নিজেই এখন বিচারক, নিজেই জল্লাদ। আর রাষ্ট্র? হামলার পর হাসপাতালে ভর্তি করানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।
এছাড়া, বিবৃতিতে পুরান ঢাকায় সোহাগ নামের একজন ভাঙারির দোকানদারকে যুবদল কর্মীদের হাতে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা এবং খুলনার দৌলতপুরে সাবেক যুবদল নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করার ঘটনাও উল্লেখ করা হয়।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির মতে, এটি কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, বরং একটি সংগঠিত সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ—যেখানে ধর্ম, গুজব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সমাজকে আতঙ্ক, দমন ও নিষ্পেষণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তারা অভিযোগ করে, সরকার এসব ঘটনা দমনে যথেষ্ট সক্রিয় নয়; বরং সরকার সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে এসব ঘটছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কথায় ও কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলেও দাবি করা হয়। সংগঠনটির দাবি, এসব ঘটনার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই সহিংসতার ইতিহাস নতুন নয়। গত এক দশকে একের পর এক ব্লগার, লেখক, একটিভিস্ট খুন হয়েছেন। তাদের ওপর চাপানো হয়েছে "নাস্তিক", "শাতিম" বা "ধর্ম অবমাননাকারী" তকমা। যারা এই তকমা দিয়েছে, তারা কখনো রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী, কখনো ধর্মান্ধ, কখনো নিছক হিংস্র। অথচ রাষ্ট্রপ্রশাসনের ভূমিকা ছিল প্রায় একই—চুপ থাকা, তদন্ত না করা, বিচার না করা।
এতে আরও বলা হয়, এমনকি যেসব দেয়ালচিত্রে একসঙ্গে অনেক নিহত ব্লগারের মুখ আঁকা হয়েছিল, সেগুলোও রক্ষা পায়নি; সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। সংগঠনটির মতে, এটি ছিল একটি প্রতিরোধের চিহ্ন, আর যারা খুন হয়েছেন তারা দঙ্গলতন্ত্রের সংগঠিত শিকার। যারা এসব হত্যাকে "বুঝতে চায়নি", "চুপ করে গেছে" অথবা "সাময়িক কৌশল" বলে পাশ কাটিয়েছে—তারা ইতিহাসে অপরাধের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।
বিবৃতির শেষাংশে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, বিদ্বেষ-সহিংসতা, মব সন্ত্রাস ও দঙ্গলতন্ত্রের বিরুদ্ধে এখনই সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। ধর্মীয় গুজব, রাজনৈতিক শত্রুতা কিংবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যেন আর কোনো নাগরিক আক্রমণের শিকার না হয় বা বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা না করা হয়—তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের।
তারা ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক মর্যাদার পক্ষে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানায়।