স্নাইপার না এয়ারগান? এক মাস পেরোলেও নড়াইলে উদ্ধার হওয়া 'অস্ত্রে'র ফরেনসিক পরীক্ষার অনুমতি মেলেনি

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার এক কলেজ ছাত্রের ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া একটি 'আগ্নেয়াস্ত্র' এখনও পর্যন্ত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো যায়নি। এক মাস পার হলেও আদালতের অনুমতি না পাওয়ায় পুলিশ পরীক্ষা চালাতে পারেনি।
এদিকে, 'স্নাইপার রাইফেল' উদ্ধারের খবর গত মাসে মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
গত ৮ জুন গভীর রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কালিয়া উপজেলার পুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা কালাম মোল্লার বাড়ি থেকে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। এটি ছিল তার বড় ছেলে সোহান মোল্লার ঘরে।
অস্ত্রটি নিয়ে নানা গুজব এবং জল্পনা-কল্পনা ছড়ালেও এখনও পর্যন্ত সেটির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি এবং এ বিষয়ে কোনো মামলা দায়েরও করা হয়নি।
৪ জুলাই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কালীয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য আমরা আদালতে আবেদন করেছি, কিন্তু এখনও অনুমতি মেলেনি। অস্ত্রটি আমাদের হেফাজতেই আছে। অনুমতি পেলেই পরীক্ষা করাব এবং পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।"
অভিযানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশজুড়ে আলোচনায় আসে উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি। মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হয়, কলেজ ছাত্রের খাটের নিচ থেকে একটি স্নাইপার রাইফেল পাওয়া গেছে। এটি ঘিরে নতুন করে নানা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষ করে, এর আগের বছরে সংঘটিত হওয়া গণঅভ্যুত্থানে 'স্নাইপার রাইফেল' ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে নতুন করে একটি স্নাইপার উদ্ধারের খবর জনমনে উদ্বেগ তৈরি করে। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের অনেকেই এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।
তবে শুরু থেকেই সোহান মোল্লার পরিবার দাবি করে আসছে, এটি একটি বৈধভাবে কেনা এয়ারগান, যার আগে থেকেই অনুমোদন ছিল।
অভিযানের সময় বাড়িতে থাকা সোহানের মা সাগরিকা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নিরাপত্তা বাহিনী যে রাইফেলটি নিয়ে গেছে, সেটি একটি এয়ারগান। সোহান তার ছেলেকে শ্যুটিং ক্লাবে ভর্তি করানোর জন্য এটি কিনেছিল। কিন্তু ছেলের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ না হওয়ায় ক্লাবে ভর্তি করা যায়নি।"
তিনি আরও জানান, এটি প্রথমবার নয়; এর আগেও ওই বন্দুকটি জব্দ করা হয়েছিল।
"২০২৫ সালে স্থানীয় কিছু যুবকের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপনের রাতে নিরাপত্তা বাহিনী সোহানের কাছে বন্দুকটি পেয়ে নিয়ে যায়। পরদিন সোহান, তার বাবা এবং শ্বশুর মিলে নিরাপত্তা বাহিনীর দপ্তরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখালে বন্দুকটি ফিরিয়ে দেয়া হয়।''
"তখন সেখানে থাকা কর্মকর্তারা বলেছিলেন, বন্দুকটি যেন অন্য কারো হাতে না যায়; এমনকি পাখি মারার কাজেও যেন ব্যবহার করা না হয়। সেই কারণেই আমি সেটি ঘরের ভেতরেই রেখেছিলাম।"
তিনি জানান, একই বন্দুক ফের আরেকটি অভিযানে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে কালীয়া থানার ওসি বলেন, "পুলিশ কখনো বলেনি যে উদ্ধার হওয়া বন্দুকটি স্নাইপার। যারা বলেছে, তারাই জানে এটা কী।"
অভিযানের পরের দিন প্রচারিত সংবাদ
গত ৯ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'নড়াইলে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার।' সেখানে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী থেকে জানানো হয়েছে, সোহান মোল্লা নামের একজন ব্যক্তি অবৈধ স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছিলেন—এমন তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান চালানো হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযানে "টেলিস্কোপ ও সাইলেন্সারসহ ৪.৫ ক্যালিবারের স্নাইপার নাইট্রো রাইফেল" উদ্ধার করা হয় সোহানের খাটের নিচ থেকে। তবে সে সময় সোহান বাড়িতে না থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
পরে অন্যান্য বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলও একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সংবাদ প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী উদ্ধার হওয়া বন্দুকের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে দাবি করেন, এটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর ব্যবহার করা রাইফেলের সঙ্গে মিলে যায়।
এই ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।
গত ১০ জুন এক ফেসবুক পোস্টে সজীব ওয়াজেদ লেখেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক অভিযান চালিয়ে সোহান মোল্লা নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার করেছে। তিনি লেখেন, "সে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'-এর সমন্বয়ক এবং এই আন্দোলনের ছায়া সংগঠন 'দ্য রেড জুলাই'-এর খুলনা জেলা শাখার প্রপাগান্ডা সেলের সদস্য ছিল।"
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, "তাহলে আমাদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে গুলি করেছিল কে?"
তবে সোহানের মা সাগরিকা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। সেই কারণেই একটি পক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াচ্ছে।"
'অস্ত্র'টি কোথা থেকে এল?
সাগরিকা বেগম জানান, তার ছেলে সোহান, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে খুলনার একটি দোকান থেকে এয়ারগানটি কিনেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সোহানের ছেলে আরাদ ইসলামকে শুটিং ক্লাবে ভর্তি করানো।
তিনি বলেন, 'আমার নাতিকে শুটিং ক্লাবে ভর্তি করানোর জন্য এয়ারগানটা কেনা হয়েছিল। আমাদের কাছে ক্যাশ মেমোও আছে।'
প্রাপ্ত রশিদ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর খুলনার ডি.কে.আর রোডের 'আলবার্ট আর্মস স্টোর' থেকে 'পিএক্স১২০ মিনওটোর' মডেলের একটি খেলনা বা স্পোর্টস এয়ারগান ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় কেনা হয়।
এ বিষয়ে জানতে দোকানের মালিক সুবোধ দুবেকে ফোন করলে তিনি প্রতিবেদককে তার ছেলে আলবার্ট দুবের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আলবার্ট রসিদের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, "সোহান আমাদের কাছ থেকে একটি স্পোর্টস এয়ারগান কিনেছিলেন। এর গুলি দোকানেও পাওয়া যায়। আমরা তাকে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করিনি।"
তিনি আরও বলেন, "সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তখনও আমি বলেছি, এটি একটি খেলনা বন্দুক। ১৯৭৪ সাল থেকে ব্যবসা করছি, এমন গুজব আগে কখনও শুনিনি—একটি এয়ারগানকে এখন স্নাইপার বলা হচ্ছে।"
সোহানের ছেলেকে শ্যুটিং ক্লাবে ভর্তি করানোর পরিবারের দাবি যাচাই করতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড যোগাযোগ করে নড়াইল রাইফেল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে।
তিনি জানান, ক্লাবের কার্যক্রম ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে বন্ধ রয়েছে।
'ক্লাবের সদস্য হতে হলে ডিসি সাহেবের (যিনি এক্স-অফিসিও সভাপতি) অনুমোদন লাগে। আর পাঁচ বছরের বাচ্চা তো এখনো স্কুলেই যায় না, শুটিং শিখবে কীভাবে?'—মন্তব্য করেন তিনি।
সোহানের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে জানতে চাইলে তার মা বলেন, অভিযানের পর থেকে সে আর ফোন ব্যবহার করে না।
'সে খুব ভয় পেয়েছে, কারও সঙ্গে কথা বলছে না। ওর বক্তব্য আমার কথার মধ্যেই আছে,' বলেন সাগরিকা বেগম।
স্নাইপার রাইফেল আসলে কী?
ফরাসি অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান পিজিএম প্রিসিশন এবং উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, স্নাইপার রাইফেল হলো একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নির্ভুল অস্ত্র, যা প্রশিক্ষিত স্নাইপারদের ব্যবহারের জন্য তৈরি। এসব রাইফেল সাধারণত ৮০০ থেকে ১,৫০০ মিটার বা তারও বেশি দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
এই ধরনের রাইফেলে সাধারণত টেলিস্কোপিক স্কোপ থাকে এবং এগুলো বোল্ট-অ্যাকশন অথবা সেমি-অটোমেটিক হয়ে থাকে। বিশ্বের পরিচিত স্নাইপার রাইফেলের মডেলের মধ্যে রয়েছে এম২৪, ব্যারেট এম৮২, অ্যাকুরেসি ইন্টারন্যাশনাল এডাব্লিউএম এবং ম্যাকমিলান টিএসি-৫০।
তবে সোহানের ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রটির যেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো গুগল রিভার্স সার্চে বেশ কয়েকটি এয়ারগানের সঙ্গে মিল পেয়েছে। অস্ত্রটির ব্যারেল এবং দেহ হালকা প্লাস্টিক বা কম্পোজিট উপাদানে তৈরি, যা সাধারণত শুটিং বা খেলাধুলার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
এখনো আতঙ্কে পরিবার
ঘটনার এক মাস পার হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি সোহানের পরিবার। মাঝে মধ্যে বাড়ি এলেও প্রতিবেশীরা এড়িয়ে চলে তাকে। নিজেও জনসম্মুখে আসা থেকে বিরত থাকছেন।
৪ জুলাই সাগরিকা বেগম মুঠোফোনে টিবিএসকে বলেন, 'সোহান এখন আত্মীয়ের বাড়িতে আছে, গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় পাচ্ছে। সে ফোনও ব্যবহার করছে না। মাঝে মাঝে বাসায় এলেও লোকজন ওকে এড়িয়ে চলে।'
তিনি আরও বলেন, "আমার ছেলের কিছু হবে না তো? দয়া করে আপনারা সত্যটা তুলে ধরুন... ওটা একটা খেলনা বন্দুক। আমরা তো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি, তাই অন্য এক পক্ষ গুজব ছড়াচ্ছে। পুলিশ কি আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে?"
সোহানের বাবা কালাম মোল্লা টিবিএসকে জানান, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন তিনি। কয়েক মাস আগে দেশে ফেরেন। এলাকায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের পরিবার সব সময় নিরপেক্ষ থেকেছে।
'আমাদের পরিবারের কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। আমি রাজমিস্ত্রি, ছেলে একজন ছাত্র। কিন্তু এই একটা এয়ারগানের কারণে আমাদের জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেছে,' বলেন তিনি।