ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন: আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে কক্সবাজার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু এই বিদ্রোহ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এতে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক আরও খারাপ হবে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে পড়বে। তাই বাংলাদেশের উচিত সীমান্তে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য ও ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো এবং শিবিরে এসব গোষ্ঠীর প্রভাব কমানো।
এই তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের 'বাংলাদেশ-মিয়ানমার: রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি' শীর্ষক এশিয়া প্রতিবেদনে। এটি আজ বুধবার (১৮ জুন) সকালে প্রকাশিত হওয়ার কথা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির অগ্রগতির পর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়েছে। কক্সবাজারের শিবিরে বহু বছর ধরে সহিংস দ্বন্দ্বে জড়িত থাকা এসব গোষ্ঠী গত নভেম্বরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর শিবিরে সহিংসতা কমে এলেও সদস্য সংগ্রহ বেড়েছে। কারণ, আরাকান আর্মি রাখাইনের বৌদ্ধ জনগণের সমর্থন পায়, তাই রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় আহ্বানের মাধ্যমে সংঘাতে নামানো হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে পরীক্ষামূলক আলোচনা শুরু করেছে। তবে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর হামলা এই আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে তা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব উসকে দেবে এবং প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে যখন আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনে অগ্রসর হয়, তখন সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নিজেদের পক্ষে লড়াইয়ে নামাতে চায়। তারা রোহিঙ্গা পুরুষদের জোর করে মিলিশিয়ায় নেয়, সম্প্রদায় নেতাদের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় যায়।
এই গোষ্ঠীগুলো আগে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করত। আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রা রোধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার সাময়িক ফল দিলেও সেনাবাহিনী পুরোপুরি সফল হয়নি। অনেক রোহিঙ্গা সেনাবাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও আরাকান আর্মির বক্তব্য ও নির্যাতনের অভিযোগ তাদের একটি অংশকে প্রভাবিত করে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মংডু শহর দখলের আগে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো অবস্থান পাল্টায়। নভেম্বরে তারা 'সহাবস্থান' সমঝোতা করে এবং ডিসেম্বরেই শিবিরে 'ঐক্য সমাবেশ' ডেকে রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। এই লড়াইকে তারা ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে 'জিহাদ' হিসেবে উপস্থাপন করে।
অতীতে সহিংস কৌশলের কারণে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা এই গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করত। কিন্তু আরাকান আর্মির বিরোধিতা এবং প্রত্যাবাসন অনিশ্চয়তায় এখন শিবিরগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য সংগ্রহের জন্য উর্বর মাটিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বহু বছর ধরে রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। তারা রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর 'ঐক্য' প্রচেষ্টায় সমর্থন দিলেও বলছে, তাদের উদ্দেশ্য শিবিরে সহিংসতা কমানো। তবে মনে হচ্ছে, তারা রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে আরাকান আর্মিকে প্রত্যাবাসনে চাপ দিতে চায়। এসব গোষ্ঠীকে তারা অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। তবে এই সম্পৃক্ততা আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের চলমান আলোচনায় ঝুঁকি তৈরি করছে। আরাকান আর্মি বর্তমানে সেইসব এলাকাই নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখান থেকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছিল।
রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর হামলায় জনমত আরাকান আর্মির বিপক্ষে গেলে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার অর্জনের পথ আরও কঠিন হয়ে পড়বে। জান্তা-বিরোধী শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রোহিঙ্গারা তাদের বিরোধিতা করলে জনগণের সহানুভূতি হারাতে পারে, নিপীড়নের ঝুঁকি বাড়বে এবং নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে।
ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, বাংলাদেশের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, রাখাইনে বাণিজ্য ও সহায়তা জোরদার করা এবং শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানো। এতে সীমান্তে স্থিতিশীলতা আসবে এবং রোহিঙ্গা নাগরিক সমাজ গড়ে উঠবে। আরাকান আর্মির উচিত রোহিঙ্গাদের আস্থায় আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং প্রমাণ করা যে তারা সবাইকে নিয়ে শাসন চালাতে সক্ষম। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈদেশিক সহায়তা কমাচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক দাতাদের উচিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে সহায়তা আরও বাড়ানো।