লন্ডনে ড. ইউনূস-মিলিব্যান্ডের বৈঠক, গুরুত্ব পাবে জ্বালানি, বিনিয়োগ ও আবহাওয়া ইস্যু

জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও বিনিয়োগ—এই তিন ইস্যুতে আলোচনা ঘিরেই আজ (১৩ জুন) লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে বৈঠকে বসছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও যুক্তরাজ্যের এনার্জি সিকিউরিটি বিষয়ক সেক্রেটারি অব স্টেট এড মিলিব্যান্ড। ঢাকা, ম্যানচেস্টার ও লন্ডনের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক রূপান্তর এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারের প্রেক্ষাপটে উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বৈঠকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যুক্তরাজ্যের সহায়তা ও স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন ড. ইউনুস।
২০২৪ সালের ৫ জুলাই এনার্জি সিকিউরিটি ও নেট জিরো বিষয়ক সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া এড মিলিব্যান্ড ব্রিটিশ রাজনীতিতে একজন অভিজ্ঞ নেতা। ২০০৫ সাল থেকে তিনি ডনকাস্টার নর্থ এলাকার এমপি। এর আগেও তিনি ২০০৮-২০১০ মেয়াদে এনার্জি ও ক্লাইমেট চেঞ্জ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন তার নেতৃত্বেই পাস হয় বিশ্বের প্রথম জাতীয় জলবায়ু আইন ঐতিহাসিক 'ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাক্ট ২০০৮'।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির জ্বালানি চাহিদা গৃহস্থালি ও শিল্প উভয় খাতেই দ্রুত বেড়েছে। সরকারের সাম্প্রতিক নীতিগত জোর পড়েছে নবায়নযোগ্য ও সৌরশক্তির ওপর, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।
এদিকে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা টেকসই বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে বলে তারা সতর্ক করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে ইউনূস-মিলিব্যান্ড বৈঠক যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়ার একটি সম্ভাব্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারে।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ইনভেস্টমেন্ট সামিটে সাফল্য পাওয়ার পর যুক্তরাজ্যের উদ্যোক্তাদের সামনে বাংলাদেশ নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরার পরিকল্পনা করছে। গত বছর বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে যাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার বৈশ্বিক পুঁজি আকর্ষণে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্যই ছিল বাংলাদেশের শীর্ষ এফডিআই উৎস দেশ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ৪৩২.৬৩ মিলিয়ন, ২০২৩ সালে ৫২৮.০৬ মিলিয়ন এবং ২০২৪ সালে ৪০৯.৬১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরাও এ অর্থনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্স ছিল ২.৬২ বিলিয়ন ডলার—যা ২০২২ সালের ২.০৭ বিলিয়নের তুলনায় অনেক বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪.৪৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই পরিমাণ ছিল ৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন করে বিন্যাসের পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৌশলগত সহযোগিতা।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও আগের বছরের তুলনায় এটি ২১ শতাংশ কম। এর পেছনে ছিল ব্রেক্সিট-পরবর্তী শুল্ক জটিলতা ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার বিঘ্ন। এইচএসবিসি বাংলাদেশ-এর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের টেক্সটাইল, ব্যাংকিং ও শিক্ষা খাতে যুক্তরাজ্যের ২৪০টির বেশি কোম্পানি কাজ করছে।
কৌশলগত, জলবায়ু ও মানবিক সহযোগিতা
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন এবং মানবিক ইস্যু, বিশেষত রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা করিডোর-এর জন্য যুক্তরাজ্যের সহায়তা আরও বাড়ানোর দাবি তুলতে পারে বাংলাদেশ।
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্য অতিরিক্ত ১২ মিলিয়ন পাউন্ড অনুদান ঘোষণা করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য। এই সহায়তার আওতায় রয়েছে বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয় এবং নারী ও শিশুদের জন্য সুরক্ষা সেবা, পাশাপাশি টেকসই ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ।
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক সংকটের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন এসেছে। এই প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার, আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্টকে আশ্বস্ত করেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে না এবং তারা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারাও বাংলাদেশের সুশাসনের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যে কূটনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। ২০২৪ সালের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের ফরেন সেক্রেটারি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটির অবদান তুলে ধরে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে তাদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
সম্ভাব্য এই বৈঠকে দুই দেশের পক্ষ থেকেই জ্বালানি, বাণিজ্য, জলবায়ু সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরসহ সামগ্রিক সহযোগিতা জোরদারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে—যা ক্রমশ কৌশলগত গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা পাচ্ছে।