যুক্তরাজ্য থেকে সাইফুজ্জামানের সম্পদ ফেরাতে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ আইনি পথ

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ১৮৫ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ জব্দকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ পাচারবিরোধী অভিযানে প্রাথমিক সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই তহবিল বাংলাদেশে ফেরত আনার পথ দীর্ঘ, জটিল এবং বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় বিদ্যমান আইনি জটিলতায় পরিপূর্ণ।
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত প্রায় শেষের পথে। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এই সম্পদ জব্দ কার্যকর করতে হলে প্রথমে ঢাকার একটি আদালত থেকে আদেশ নিতে হবে। সেই আদেশ পারস্পরিক আইনি সহায়তার (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট) কাঠামোর আওতায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অনুরোধের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
তবে এটি কেবল প্রাথমিক ধাপ। বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাজ্যে একটি পৃথক দেওয়ানি মামলা করতে হবে, যেখানে সম্পদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তা প্রমাণ করতে হবে যে সম্পদগুলো অবৈধভাবে অর্জিত।
এমনটি প্রমাণিত হলে যুক্তরাজ্যের আদালত বাজেয়াপ্তির আদেশ দিতে পারেন। তবে এখানেই প্রক্রিয়া শেষ নয়। এরপর সেই সম্পদ বিক্রির অনুমতি নিতে এবং অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে আরেকটি মামলা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বহুস্তরবিশিষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। তার আগে পর্যন্ত উভয় দেশের বিচারিক প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এসব জব্দকৃত সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর সম্ভব নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যুক্তরাজ্যে সম্পদ জব্দ হওয়া নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, তবে স্রেফ এটি এই সম্পদের অবৈধতা প্রমাণ করে না।
তার ভাষায়, 'এসব সম্পদ অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত—এটি আদালতে প্রমাণ করতে হলে বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে, যা দেখাবে যে এসব সম্পদ কিনতে ব্যবহৃত অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।'
বাংলাদেশি আদালত যখন এই সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত বলে ঘোষণা করবেন, তখন বাংলাদেশের আইনজীবী দল পারস্পরিক আইনি সহায়তার কাঠামোর আওতায় যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতা চাইতে পারবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এরপর যুক্তরাজ্যের একটি আদালত স্বাধীনভাবে বাংলাদেশের উপস্থাপিত প্রমাণ মূল্যায়ন করবেন। যদি আদালত সেটি সন্তোষজনক মনে করেন, তাহলে বাজেয়াপ্তির অনুমতি দেবেন। এরপর এসব সম্পদ বিক্রি করে তা বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য আরেকটি মামলা করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, এই পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের আদালতে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক মানের আইনি সংস্থা নিয়োগের চেষ্টা করছে।
তবে এই প্রসঙ্গে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'বাংলাদেশকে অবশ্যই এ ধরনের আইনজীবী সংস্থা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, এদের অনেকেই অতীতে অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই অত্যাবশ্যক।'
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩০০টিরও বেশি সম্পদ জব্দ করেছে।
এনসিএ জানিয়েছে, ৫ জুন লন্ডনের হাইকোর্ট থেকে আদেশ পাওয়ার পর তারা ১৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের মোট ৩৪২টি সম্পত্তি জব্দ করে। এই তালিকায় লন্ডনে অবস্থিত ১১ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাড়িও রয়েছে।
ব্লুমবার্গ-এর তথ্যমতে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর নামে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি রয়েছে। এর আগে আল জাজিরার একটি তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছিল, তিনি কেবল যুক্তরাজ্যেই ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তির মালিক এবং লন্ডন, দুবাই ও নিউইয়র্কে রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছেন।
চলতি বছরের মে মাসে এনসিএ একই ধরনের আরেকটি পদক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান ও ভাগ্নে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নয়টি সম্পত্তি জব্দ করে। এসব সম্পত্তির মূল্য ১১০ মিলিয়ন পাউন্ড, যা প্রায় ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার সমান।
'দুদককে আরও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে'
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগ্রহ বাড়লেও পাচারকৃত অর্থ ফেরতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তব অভিজ্ঞতা এখনও সীমিত। এ পর্যন্ত একমাত্র উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনা ২১ কোটি টাকা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ওই মামলায় সিঙ্গাপুর স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করেছিল, যার ফলে অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়াটি তুলনামূলকভাবে সহজ হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'এর বিপরীতে যুক্তরাজ্য থেকে সম্পদ উদ্ধার করা হবে অনেক বেশি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। যুক্তরাজ্য সম্পত্তি জব্দ করলেও প্রকৃত অর্থ ফেরত আনতে হলে সফল মামলা ও সমন্বিত আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।'
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক মহাপরিচালক ও প্রাক্তন সিনিয়র জেলা জজ মঈদুল ইসলাম জানান, সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে সম্পত্তি হস্তান্তর থেকে বিরত রাখতে দুদক ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর ঢাকার একটি আদালত থেকে একটি আদেশ পায়।
ওই আদেশে সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের বাংলাদেশ ও বিদেশে মালিকানাধীন মোট ৫৮০টি স্থাবর সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বাংলাদেশের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে দুদক দায়ের করা একটি পৃথক মামলায় সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সাবেক চেয়ারম্যান রুখমিলা জামানের বিরুদ্ধে একটি ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়।
মঈদুল ইসলাম বলেন, 'এর পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে ওই জব্দাদেশ পাঠানো হয় পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধ হিসেবে। সেই ভিত্তিতেই ব্রিটেনের এনসিএ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।'
তবে তিনি সতর্ক করে দেন, বাংলাদেশের আদালতের পূর্ণাঙ্গ বিচার ও রায় ছাড়া এই সম্পদ সম্পূর্ণরূপে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব নয়।
তার ভাষায়, 'এখন দুদককে অর্থ পাচারের মামলা দায়ের করতে হবে, তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দাখিল করতে হবে। আদালত যদি মনে করেন সাইফুজ্জামান বা অন্য কোনো অভিযুক্ত অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচার করে এসব সম্পদ অর্জন করেছেন, তবেই চূড়ান্ত বাজেয়াপ্তির আদেশ আসতে পারে।'
তিনি দুদককে আরও দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'দুদকের নিজস্ব বিধি অনুযায়ী ২৭০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার কথা। অথচ তারা ইতোমধ্যে নয় মাসের বেশি সময় নিয়েছে। এখন, যখন যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন আর কোনো বিলম্বের অজুহাত থাকতে পারে না।'
দুদক ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে পারস্পরিক আইনগত সহায়তার অনুরোধ (এমএলএআর) পাঠিয়েছে। এসব অনুরোধে সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের মালিকানাধীন সম্পত্তির আর্থিক নথিপত্র, মালিকানা কাঠামো এবং সম্পদ ক্রয়ের জন্য ব্যবহৃত অর্থের উৎস সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
বৃহত্তর তদন্ত
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাজ্যে এক উচ্চপর্যায়ের সফরে রয়েছেন। জানা গেছে, পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারের বিষয়টি এই সফরের আলোচ্য বিষয়গুলোর অন্যতম শীর্ষ এজেন্ডা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত মোট ১১টি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ পুনরুদ্ধার মামলাকে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করেছে। সূত্র জানায়, এই তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের পরিবারের মামলার পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সাইফুজ্জামান সংক্রান্ত মামলা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে এস আলম গ্রুপ, এরপর রয়েছে বেক্সিমকোসহ সালমান এফ রহমান-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মামলা।
আইনি প্রস্তুতি জোরদারে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফরেনসিক ও আইনি সহায়তাদানকারী বিশেষায়িত সংস্থাগুলো নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এসব সংস্থা আইনি নথিপত্র প্রস্তুতকরণ, আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব এবং সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন চিহ্নিত ও অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেবে।
এদিকে, বসুন্ধরা গ্রুপ, সামিট গ্রুপ এবং নাফিস সারাফাতের মতো অন্যান্য আলোচিত পাচার সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোকেও যেন তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়ার দিক থেকে অবহেলিত না হয়, তা নিশ্চিত করতেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট রয়েছে।
যদিও দেশের আদালত ইতোমধ্যে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদেশে সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট বিদেশি আদালত ও বিচারব্যবস্থা এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।