ইতিহাসের বৃহৎ সমাবর্তনে উৎসবমুখর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ক্যাম্পাসে এখন যেন উৎসবের আবহ। দেশের অন্যতম বৃহৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সবুজ-শ্যামল ২৩০০ একরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আলোর ঝলকানি, রঙিন সাজসজ্জা ও উচ্ছ্বাসে ভরা শিক্ষার্থীদের পদচারণা।
দীর্ঘ ৯ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন। যা অংশগ্রহণের দিক থেকে দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছেন প্রায় ২৩ হাজার গ্র্যাজুয়েট। ২০১১ থেকে ২০২৩ সালে মধ্যে অনার্স, মাস্টার্স এবং ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এমফিল, পিএইচডি সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা এবারের সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করছেন। সফলভাবে সমাবর্তন সম্পন্ন করতে কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি উপ-কমিটি।
সমাবর্তনের বিশেষ আকর্ষণ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক এবার সমাবর্তন বক্তা হিসেবে অংশ নিচ্ছেন এবং বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ডক্টর অব লেটারস (ডি-লিট) ডিগ্রি দেওয়া হবে।

এছাড়া সমাবর্তনে অতিথি হিসেবে থাকবেন জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
ক্যাম্পাসে সাজ সাজ রব
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নাম্বার গেইট থেকে শুরু করে জিরো পয়েন্ট, শহীদ মিনার, প্রশাসনিক ভবন, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ এলাকা, সোহরাওয়ার্দী হলসংলগ্ন সড়ক সবখানেই সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে সাজ-সজ্জার ব্যস্ততা চলছে।
ক্যাম্পাসজুড়ে রঙিন ব্যানার, আলোকসজ্জা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ যেন এক নতুন রূপ দিয়েছে পুরো এলাকাকে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্যান্ডেল। কাজ চলছে দিনরাত। প্যান্ডেলের ভেতরে বসার আসন, অতিথিদের জন্য পৃথক স্টল, আইসিইউসহ মেডিকেল কর্নার ও খাবারের স্টল নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।
সমবর্তীরা দল বেঁধে আসছেন ক্যাম্পাসে। কেউ গাউন সংগ্রহ করছে, কেউ ছবি তুলছে প্রিয় জায়গাগুলোর সামনে। সবার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। কেউ কেউ নিজের বাবা-মাকে সঙ্গে এনেছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই ক্যাম্পাস আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সাজানো ক্যাম্পাস দেখে এক নতুন ভালোবাসায় ভরে উঠছে মন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরাও ব্যস্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজে। কোথাও ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছে, কোথাও রঙ করা হচ্ছে ভবনের দেয়াল। এ যেন সত্যিকারের উৎসবমুখর পরিবেশ যার কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে সাবেক শিক্ষার্থী সমবর্তী রনি কুমার নাথ বলেন, 'ক্যাম্পাসে আমরা সাতটি বছর অতিবাহিত করেছি। সুযোগ পেলেই ক্যাম্পাসে আসার কোনো উপলক্ষ খুঁজি আমরা। সমাবর্তন আমাদের কাছে একটি আবেগের বিষয়। সিনিয়র, জুনিয়র, সম্মানিত শিক্ষক সবার সঙ্গে দেখা হবে এটা এক অন্যরকম অনুভূতি।'
সমাবর্তন প্রস্তুতিতে চূড়ান্ত পর্বে আয়োজকরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন ঘিরে চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছে আয়োজক কমিটি। ইতোমধ্যে নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের গাউন, টুপি ও উপহারসামগ্রী বিভাগে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আজ থেকে আগামী বুধবার (১৪ মে) দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিজ নিজ বিভাগ থেকে এসব সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে সমাবর্তন শেষে গাউন ফেরত না দিলে সার্টিফিকেট ও উপহার সামগ্রী দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সমাবর্তনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য উপহার হিসেবে থাকছে একটি মোবাইল ওয়ালেট, একটি কোর্ট পিন, একটি কলম এবং একটি পাটের ব্যাগ।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সময়সূচি
অনুষ্ঠানের দিন দুপুর পৌনে ২টায় সমাবর্তন শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। তবে এতে শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারবেন না। দুপুর ২টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন বক্তব্য রাখবেন উপাচার্য, দুই উপ-উপাচার্য, ইউজিসির চেয়ারম্যান, শিক্ষা উপদেষ্টা ও ডি-লিট সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তি। অনুষ্ঠানটি শেষ হবে বিকেল ৪টায়।
শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুর ১২টার মধ্যে খাবার সংগ্রহের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। বেলা ১টার মধ্যে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের প্যান্ডেলে প্রবেশ করতে হবে। এরপর প্যান্ডেলে ঢোকার সুযোগ থাকবে না। মূল ভেন্যুতে আমন্ত্রণপত্র ও মোবাইল ফোন ছাড়া অন্য কিছু নেওয়া যাবে না।

যানবাহন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সমাবর্তনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আসা অভিভাবক বা অতিথিরা মূল ভেন্যুতে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাদের জন্য বিভাগভিত্তিক কক্ষে বসার ব্যবস্থা থাকবে। যাতায়াতের সুবিধার্থে নগরীর নিউমার্কেট, বটতলী রেলস্টেশন, ওয়াসা মোড়, ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্স ও পলিটেকনিক মোড় থেকে প্রায় ১০০টি বাস সকাল ৬টা থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। এতে কেবল নিবন্ধিত শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করতে পারবেন।
সমাবর্তনের দিন ক্যাম্পাসে কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না। ১ নম্বর গেট ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর জন্য ২০টি শাটলবাস সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত যাতায়াত করবে। এতে শিক্ষার্থীদের স্বজনরাও যাতায়াতের সুযোগ পাবেন। এছাড়া নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী শাটল ট্রেন চলাচল করবে এবং এতে শিক্ষার্থী ছাড়াও তাদের স্বজনরা যাতায়াত করতে পারবেন।
নিরাপত্তায় নিশ্ছিদ্র বলয়
সমাবর্তনকে ঘিরে পুরো ক্যাম্পাসকে নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিরাপত্তা তদারকিতে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশ। যারা মূল ভেন্যুতে প্রবেশ করতে পারবেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড় পর্দায় সরাসরি অনুষ্ঠান দেখানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আয়োজকরা বলছেন, এবারের সমাবর্তন ঘিরে ক্যাম্পাসে প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, অতিথি মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হবে যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ সমাবর্তন হয়ে থাকবে।
সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ- উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী ইতিমধ্যে গ্রাউন্ডে আছেন। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স নিয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পাশাপাশি রেলওয়ে পুলিশও নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার বিষয়ে নজর রাখছেন।

১৪ কোটি টাকার আয়োজন, ৩ কোটির প্যান্ডেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তনের প্রাক্কলিত বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এসেছে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ফি থেকে এবং বাকি অর্থ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি ও স্পন্সররা। আয়োজন সফল করতে গঠন করা হয়েছে ১৯টি উপকমিটি। এরমধ্যে ৩ কোটি টাকা ভেন্যু নির্মাণে এবং ২ কোটি টাকা সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য উপকরণে ব্যয় ধরা হচ্ছে।
সরাসরি সম্প্রচারে বিটিভি, ক্যাম্পাসজুড়ে এলইডি স্ক্রিন
বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) পুরো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে। সমাবর্তনে ৭৮ জন গণমাধ্যমকর্মী দায়িত্ব পালন করবেন যাদের মধ্যে ২৮ জন থাকবেন বিটিভির। একই সঙ্গে অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখানোর জন্য পুরো ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হয়েছে এলইডি স্ক্রিন।
কোন অনুষদ থেকে কতজন অংশ নিচ্ছে
পঞ্চম সমাবর্তনে ৪২ জন পিএইচ,ডি. এবং ৩৩ জন এম.ফিল, ডিগ্রিসহ মোট ২২ হাজার ৫৮৬ জন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হবে। কলা ও মানববিদ্যা ৪৯৮৮ জন, বিজ্ঞান ২৭৬৬ জন, ব্যবসা প্রশাসন ৪৫৯৩ জন, সমাজবিজ্ঞান ৪১৫৮ জন, জীববিদ্যা ১৬৮৫ জন, ইঞ্জিনিয়ারিং ৭৯৬ জন, আইন ৭০৩ জন, শিক্ষা ৩১৭ জন, মেরিন সায়েন্স ২৮৪ জন, চিকিৎসা ২২৯৬ জন বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ১০টি অনুষদের অধীনে বর্তমানে ৪৮টি বিভাগ, ০৬টি ইনস্টিটিউট এবং ০৫টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮৫১৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষক সংখ্যা ৯৯৬, কর্মকর্তা ৪৪৫, কর্মচারী (৩য় শ্রেণী)-৫৪৫ জন এবং কর্মচারী ৪র্থ শ্রেণী ৯৮৩ জন। শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ১৪টি হল রয়েছে। ছাত্রদের জন্য ০৯ টি ছাত্রীদের জন্য ০৫টি এবং হোস্টেল রয়েছে ১টি। স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রী ছাড়াও এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল, পিএইচ.ডি, এম.ডি, এম.এস (মেডিক্যাল সায়েন্স) উচ্চতর ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, আমাদের এই সমাবর্তন একটি বিরাট সমাবর্তন। একই ভেন্যুতে এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। দীর্ঘদিন সমর্থন না হওয়াতে সংখ্যাটা এত বিশাল হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে আমরা প্রস্তুত। সমাবর্তন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আমরা সকলের সহযোগিতা চাই।