জনপ্রিয় হচ্ছে মাচায় আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি, সারাদেশে ৬৫৩টি মডেল ঘর নির্মাণ

উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে 'মাচা পদ্ধতি' বা অহিমায়িত আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি। সাশ্রয়ী ও প্রথাগত এই পদ্ধতি হিমায়িত সংরক্ষণাগারের টেকসই বিকল্প হিসেবে হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে নির্মিত উঁচু ও বাতাস চলাচলের উপযোগী এসব মডেল ঘরে প্রাকৃতিক উপায়ে আলুসহ অন্যান্য ফসল সংরক্ষণ করা যায়। এতে চাষীদের হিমায়িত সংরক্ষণাগারের ওপর নির্ভরতা কমছে।
চাষীরা জানান, সরকারি উদ্যোগে চালু হওয়ায় এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণের জন্য তাদের বলতে গেলে কোনো খরচই হচ্ছে না। পাশাপাশি, ঘরে প্রাকৃতিক বাতাস চলাচল, আর্দ্রতা ও সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষা পাওয়ায় আলুর গুণগত মানও অক্ষুণ্ন থাকছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এই পদ্ধতিতে ভোক্তারাও ন্যায্য দামে আলু পাবেন। হিমাগার মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে কৃষকবান্ধব প্রযুক্তিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আলুর দাম কম থাকায় এবার অনেকেই হিমাগারে জায়গা পাননি। বগুড়ার সদরের সাবগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, এবার টাকা দিয়েও হিমাগারে জায়গা মেলেনি। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নির্মিত অহিমায়িত মডেল ঘরে অন্তত ৩০ টন আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন বিনা খরচে। এতে করে বড় অঙ্কের খরচ বেঁচে যাচ্ছে।
ঘরের ডিজাইন ও স্থায়িত্ব
এক একটি মডেল ঘর নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। ব্যবহৃত হয়েছে বাঁশ, কাঠ, ঢেউটিন, সিমেন্টের পিলার, ককসিটসহ অন্যান্য উপকরণ। প্রতিটি ঘরের দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট ও প্রস্থ ১৫ ফুট। এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে কৃষকদের জমিতে। ঘরগুলো ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী।
এই ঘর উঁচু, খোলা ও আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে তৈরি করতে হয় যাতে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব না থাকে এবং বাতাস চলাচলের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে। সঠিকভাবে বাছাই করা আলুই এখানে সংরক্ষণযোগ্য। কাটা, ফাটা, অপরিপক্ক, রোগাক্রান্ত বা খোসা ওঠা আলু রাখা যাবে না। সূর্যের আলো ও বৃষ্টির পানি যেন এই ঘরে প্রবেশ করতে না পারে—সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের উদ্যোগ
আলু সংরক্ষণে সিন্ডিকেট ভাঙতে 'আলু সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এর আওতায় দেশের ১৬ জেলার ৪০টি উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে মডেল ঘর।
মোট ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশে ৭০৩টি মডেল ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে গত তিন বছরে সম্পন্ন হয়েছে ৬৫৩টি। ২০২৫ সালের মধ্যে বাকি ঘরগুলো নির্মাণ শেষ হবে। প্রতিটি ঘরে ১০ জন চাষী আলু রাখতে পারবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৬৫টি হিমাগারে মোট ৩২ লাখ টন আলু সংরক্ষণের সুযোগ আছে। অথচ দেশে বছরে উৎপাদন হয় প্রায় ১১৫ লাখ টন আলু। চাহিদা ৮০ লাখ টনের মতো। ফলে বড় একটি অংশ সংরক্ষণের বাইরে থেকে যায়। রপ্তানি ব্যবস্থাও সীমিত হওয়ায় প্রচুর আলু নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় প্রযুক্তিতে অহিমায়িত মডেল ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ইতোমধ্যে সুফল দিতে শুরু করেছে।
বগুড়ার পরিস্থিতি
বগুড়ায় এবার ৬০ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে ১২ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। জেলায় চাহিদা ৩ লাখ টনের মতো। এখানে ৪২টি হিমাগারে ধারণক্ষমতা ৪ লাখ টন। বাকি আলু সংরক্ষণের অভাবে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের জন্য ৪০টি অহিমায়িত মডেল ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
বগুড়ায় প্রান্তিক চাষীদের জন্য নির্মিত মডেল ঘরগুলোর মধ্যে একটি পেয়েছেন শিবগঞ্জ উপজেলার চাষী শাকিল আহমেদ।
তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা এবার বিপাকে পড়েছিলেন, তবে মডেল ঘরের কারণে অন্তত চার মাস বিনা খরচে আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন।
"গুণগত মান ঠিক রেখে ইচ্ছেমতো বিক্রি করতে পারছেন সবাই। ভবিষ্যতে আরও অনেকেই নিজের খরচে এমন ঘর তৈরি করবেন," বলেন শাকিল।
শাজাহানপুর উপজেলার খরনা এলাকার চাষী মিজানুর রহমান বলেন, "মডেল ঘরে আট বিঘা জমির আলু সংরক্ষণ করেছি। হিমাগারে যেখানে বিদ্যুৎ দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেখানে মডেল ঘরে প্রাকৃতিকভাবেই তা নিয়ন্ত্রিত হয়।"
তিনি একই ঘরে রসুনও সংরক্ষণ করছেন এবং এখন পর্যন্ত সবই ভালো আছে বলে জানালেন। তার বিশ্বাস, এই প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য কার্যকর হবে।

সংরক্ষণ করা যায় অন্যান্য ফসলও
এখানে শুধু আলু নয়, পেঁয়াজ, মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, কচুরমুখিও সংরক্ষণ করা যায়।
কাহালু উপজেলার মনোহালি এলাকার কৃষক আবু তাহের প্রামাণিক জানান, তিনি এখন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। প্রাকৃতিকভাবে আলো ও বাতাস চলাচলের কারণে বিভিন্ন ধরনের ফসল সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, "আগের দিনের চাষীরাও এভাবে ফসল রাখতেন। এতে খরচ কম এবং ফলও ভালো থাকছে। এলাকায় অনেকেই এমন ঘর তৈরি করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।"
কৃষি বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় অনেক চাষী মাঠ থেকেই আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। পরে এই আলু হিমাগার সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যায়। তারাই তখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে আলুর দাম অস্থির হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মডেল ঘর কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বগুড়ার সিনিয়র কর্মকর্তা মমতা হক টিবিএসকে বলেন, "কিছু নিয়ম মেনে এই ঘরে আলু রাখলে গুণগত মান ভালো থাকে। প্রচলিত হিমাগারের আলুর মতো এখানকার আলুও বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। হিমাগার মালিকদের একচেটিয়া দৌরাত্ম্যের কারণে চাষীরা মডেল ঘরের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।"
আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক মনে করেন, কৃষকবান্ধব এই মডেল ঘর আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তিনি জানান, "গত বছর রংপুর ও মুন্সিগঞ্জে অনেকে মডেল ঘরে আলু রেখে লাভবান হয়েছেন। অনেক চাষী এখন নিজ খরচে এমন ঘর তৈরি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। চাষীরা নিজেদের হাতে আলু রাখতে পারলে বাজারেও দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।"