ভবেশের মৃত্যু: অপরাধমূলক ঘটনার অভিযোগকে ভারত বলছে ‘পদ্ধতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়ন’

দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় পূজা উদযাপন পরিষদের একজন নেতা ভবেশ চন্দ্র রায়ের (৫৫) মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তার মৃত্যুর চার দিন পরে হওয়া মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভবেশকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে মারপিট করে হত্যা করে।
তবে পুলিশ বলছে, সুরতহাল প্রতিবেদনে ভবেশের শরীরে মারপিট কিংবা কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
ভবেশ চন্দ্র রায় দিনাজপুরের বিরল উপজেলার শহরগ্রাম ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের মৃত তারক চন্দ্রের ছেলে। পেশায় তিনি একজন কৃষক। ভবেশ বিরল উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ভবেশের পরিবারসূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে স্থানীয় মো. রতন (৩২) ও আতিক (৩৩) নামের দুই যুবকসহ মোট চারজন দুটি মোটরসাইকেলে ভবেশের বাড়িতে আসেন। ফুলবাড়ী বাজারে (বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে) নিয়ে যাবার কথা বলে, ভবেশকে তাদের মোটরসাইকেলে তোলেন। এরপর রাত আটটায় নাড়াবাড়ি নামের একটি বাজার থেকে রতন মুঠোফোনে ভবেশের ছেলেকে তার বাবার অসুস্থতার কথা জানায়। পরে স্বজনরা ভবেশকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত ভবেশের ছেলে স্বপন চন্দ্র দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে সদস্য স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে দিনাজপুর শহরের কালীতলা এলাকায় থেকে ফ্রিল্যান্সিং পেশায় রয়েছেন।
স্বপন বলেন, 'ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭ টা ৫৭ মিনিটে বাবার ফোন থেকে আমার আমার সাথে কথা বলেন রতন। তিনি আমাকে বলেন, তোমার বাবা নাড়াবাড়িতে আছে পান-বিড়ি খেয়েছে। অসুস্থ হয়ে এখন বমি করতেছে। সে সময় আমি বলি, তাহলে একটা ভ্যানে তুলে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরে আবারও ফোন দিয়ে বলে, তোমার বাবার অবস্থা খুবই খারাপ বাড়িতে পাঠানো যাবে না, তুমি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাও। পরে আমি রতন ভাইকে বলি বাবাকে নাড়াবাড়ি থেকে ফুলবাড়ী বাজারে নিয়ে আসেন, আমি শহর থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসছি। অ্যাম্বুলেন্সে বাবাকে নিয়ে রাত সোয়া নয়টায় মেডিকেলে ভর্তি করাই। তৃতীয় তলায় ডাক্তার ইসিজি করে বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।'
ভবেশের মৃত্যুর বিষয়ে তৈরি হওয়া ধুম্রজাল স্থানীয় গণ্ডি পেরিয়ে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বিষয়টি উপস্থাপিত হচ্ছে নানাভাবে।
ভবেশের পরিবার থেকে কখনো দাবি করা হয়নি যে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ভবেশের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে দাবি করছেন তার স্ত্রী সান্তনা রানী (৪৫)। পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদনেও ভবেশের শরীরে মারপিট কিংবা কোন আঘাতের চিহ্ন নেই বলে নিশ্চিত করেছে।
কী হয়েছিল সেদিন
নিহত ভবেশের বাড়ি সংলগ্ন ফুলবাড়ী হাট এলাকার দোকানদাররা জানান, ব্যক্তিজীবনে ভবেশ ছিলেন বিনয়ী ও মিশুক প্রকৃতির মানুষ। এক সময় জমিজমা অনেক ছিল। বর্তমানে নিঃস্ব প্রায়। দুই সন্তানের পিতা ভবেশ চন্দ্র রায়। বছর পাঁচেক আগে একমাত্র মেয়ে শ্বশুরালয়ে মারা যায়। ছেলে স্বপন চন্দ্র রায় (২৫) দিনাজপুরে মেসে থাকেন।
বয়সের বড় ব্যবধান থাকলেও স্থানীয় যুবক মো. রতন (৩২) এবং বাসুদেবপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে আখতারুল ইসলাম ওরফে আতিকের (৩৩) সাথে ভবেশের বেশ সখ্যতা ছিল।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মোটরসাইকেলযোগে তারা প্রায় চার কিলোমিটার দূরে নাড়াবাড়িহাটে যান। সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় নাড়াবাড়ি বাজারে (দুধ হাটি) অহিদুলের দোকানে চা পান করেন ভবেশ, আতিক, রতনসহ মোট পাঁচজন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই বাজারের চা বিক্রেতা অহিদুল ইসলাম বলেন, ভবেশসহ আরও কয়েকজন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমার এখানে চা খায়। তখনো ভবেশের মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা দেখিনি। চা খেয়ে পাশের দোকান থেকে পান ও বিড়ি নেয়।
পান দোকানদার মতিবর রহমান বলেন, 'পান খাওয়ার এক পর্যায়ে হাটখোলার একটি ঘরের খুঁটিতে হেলান দেন। পরে হয়তো মাথা ঘুরে যায়। সেখানে বসে পড়ে। এসময় তার সাথে থাকা কয়েকজনসহ স্থানীয়রা ধরাধরি করে পাশেই ডাক্তারের (পল্লী চিকিৎসক) ওখানে নিয়ে যায়।'
পল্লী চিকিৎসক লিটন ভবেশের প্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ) মেপে দেখে মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে নাড়াবাড়ি বাজার থেকে সাদ্দাম হোসেনের (৩২) ভ্যানে তোলা হয় ভবেশকে।
ভ্যানচালক সাদ্দাম হোসেন মোবাইলে বলেন, 'ভ্যানে দুইজন বসা ছিল। ভ্যানের পিছনে মোটরসাইকেল নিয়ে আসছিল দুইজন। বাজারের শেষ মাথায় রহমান ডাক্তারের (পল্লী চিকিৎসক) চেম্বারেও রোগীর প্রেসার মাপা হয়। তিনিও হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বলেন। এরমধ্যে ভ্যানে রোগীর সাথে থাকা একজন উনার (ভবেশের) ছেলেকে ফোনে তার বাবার অসুস্থতার কথা জানান। (নিহতের ছেলে স্বপন চন্দ্র) নিজেও তা স্বীকার করেছেন। মুঠোফোনে স্বপন তার বাবাকে বাড়িতে রেখে আসার জন্য বলেন। পরে ফুলবাড়ী হাটে আসলে সেখানেও ডা. কৃষ্ণের (পল্লী চিকিৎসক) দোকানের সামনে প্রেসার মাপা হয়। সেখান থেকে ফোনে তার ছেলেকে শহর থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য বলা হয়। রাত প্রায় সাড়ে আটটার সময় অ্যাম্বুলেন্স আসে। ততক্ষণে রোগীর বাড়ির লোকজনও আসে।'
ভবেশকে নিয়ে তার ছেলে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন রাত ৯টা ১৮মিনিটে। ছেলে স্বপন চন্দ্র বলেন, 'বাবাকে প্রথমে হাসপাতালের তৃতীয় তলায় নিয়ে যাই। সেখানে ডাক্তার ইসিজি পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুসনদ নিয়ে আমরা বাড়ি চলে আসি।'
পরে রাত পৌনে বারোটায় স্থানীয় আফসার হোসেন নামের এক ব্যক্তি বিরল থানা পুলিশকে ভবেশের মৃত্যুর বিষয়ে অবহিত করেন।
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস ছবুর বলেন, "ফোনে ওই ব্যক্তি বলেন, 'বাসুদেবপুরে একজন মানুষকে কিছু খাওয়ায় মেরে ফেলেছে। জানতে পেরে রাত সাড়ে বারোটায় নিহতের বাসায় যাই। পরে সুরতহাল করি। নিহতের গায়ে কোথাও কোন মারপিট কিংবা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। যেহেতু সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে তাই মরদেহ পোস্ট মর্টেম করা হয়েছে।"
গত শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নিহতের ময়নাতদন্ত করেছেন দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মাঈনুদ্দিন।
এই চিকিৎসক সাংবাদিকদের বলেন, 'ভিসেরা প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত তেমন কিছু বলা যাবে না। শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনই পরিস্কার করে কিছু বলা যাবে না।'
ভবেশের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচারের পর, ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় নিন্দা জানায় ভারত। এই মৃত্যুকে 'বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর পদ্ধতিগত নিপীড়ন' বলে দাবি করে দেশটি।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সেও (সাবেক টুইটার) পোস্টে এ দাবি করেন।
আত্মগোপনে আতিক ও রতন
এ ঘটনায় সংবাদ প্রচার ও দুই দেশের বিবৃতির পর এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরইমধ্যে আত্মগোপনে গেছেন অভিযুক্ত আতিক ও মো. রতন। আতিক ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব এবং রতন ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক।
স্থানীয় সূত্র জানায়, উভয়ে এলাকায় দাদন ব্যবসার সাথে যুক্ত। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে এলাকায় মাদকেরও একটি সিন্ডিকেট চালায় তাদের একটি চক্র।
ভবেশের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা
ভবেশের মৃত্যুর প্রায় চার দিন পরে তার ছেলে স্বপন চন্দ্র বাদী হয়ে বিরল থানায় মামলা করেছেন। চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
মামলার আসামিরা হলেন, বাসুদেবপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে আতিকুর রহমান (৪০), শহরগ্রাম এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে রতন ইসলাম (৩০), নওসিংপাড়ার আব্দুল মাজেদের ছেলে মুন্না ইসলাম (২৭) এবং পাঁচশালা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে মো. রুবেল (২৮)।
মামলার সংক্ষিপ্ত এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিদের সাথে নিহত ভবেশ চন্দ্রের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। ভবেশের বাড়িতে আসামিদের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। আসামিরা স্থানীয়ভাবে দাদন ব্যবসার সাথে যুক্ত। এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ব্যাংকের চেক এবং নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এ অঙ্গীকারনামা লিখে তারা এই ব্যবসা করে আসছিলেন। অনেকের মত নিহত ভবেশ চন্দ্র রায়ও— আসামী আতিকুরের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণের সুদ বাবদ প্রতিমাসে ৩ হাজার ২৫০ টাকা পরিশোধ করতেন ভবেশ চন্দ্র রায়। সংসারের অভাবের কারণে গত ১ বছর ধরে সেই টাকা পরিশোধ করতে পারছিলেন না।
ঘটনার দিন গত বৃহস্পতিবার অনুমান বিকেল সাড়ে চারটায় আসামিরা ভবেশের বাড়িতে আসে এবং তাকে কৌশলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় এবং পরিবার থেকে ভবেশের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। আসামিরা ভবেশকে সুদের টাকার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করেন। এতে ভবেশ চন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যা পৌনে আটটায় আসামি রতন ইসলাম নাড়াবাড়ি বাজারে ভবেশের মোবাইল থেকে তার ছেলে স্বপনকে বাবার অসুস্থতার কথা জানায়। স্বপন সেসময় তার বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার কথা বলেন। পরে আসামিরা একটি ভ্যানযোগে ভবেশকে ফুলবাড়ী বাজারে নিয়ে আসে রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় রাখেন। ঘটনাস্থলে স্থানীয়রা জড়ো হলে আসামিরা পালিয়ে যায়। পরে দিনাজপুর শহর থেকে ছেলে স্বপন চন্দ্র রায় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফুলবাড়ী বাজারে এসে ভবেশকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক ভবেশের স্বজনদের জানান, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
এজাহারে স্বপন চন্দ্র উল্লেখ করেন, 'আসামিরা আমার বাবাকে বাড়ি থেকে ডেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে মারপিট করে হত্যা করে।'
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আনোয়ার হোসেন বলেন, এ বিষয়ে বিরল থানায় একটি এজাহার আমলে নিয়ে ৩০২/৩৪ ধারায় মামলা গ্রহণ নেওয়া হয়েছে। মামলা নং ১১৯। দিনাজপুর জেলা পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।