গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হবে, উপদেষ্টা পরিষদে অধ্যাদেশের সংশোধনী অনুমোদন

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের একটি প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এ সংশোধনের লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারের মালিকানা ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা।
সংশোধনী প্রস্তাবে ব্যাংকের বোর্ডে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমানোর কথাও বলা হয়েছে। এ সংশোধনীর ফলে সরকারের হাতে চেয়ারম্যানসহ তিনজন পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা কমিয়ে মাত্র একজনে নেমে আসবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের খসড়া করা অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত পরিবর্তনের ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের সুবিধাভোগীদের শেয়ার মালিকানা বর্তমানের ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯০ শতাংশে উন্নীত হবে।
গতকাল (১৭ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগে গ্রামীণ ব্যাংক যখন কাজ করত, তখন একটি মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করত। সেই মূল্যবোধটি হলো, যারা গ্রামীণ ব্যাংকের সুবিধাভোগী তাঁদেরই গুরুত্ব থাকবে এই ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে।
'কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। তখন তার দর্শন থেকে সরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশ নেওয়া হয়,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, যে অধ্যাদেশ সংশোধন করা হলো, তাতে আগে গ্রামীণ ব্যাংক কেবল ভূমিহীনদের জন্য কাজ করত। এখন ইউনিয়ন ও পৌরসভা উভয় পর্যায়েই বিত্তহীনদের নিয়েও কাজ করবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ব্যাংকটিতে সরকারের মালিকানা ও বোর্ড প্রতিনিধিত্ব ২০১১ সালের পূর্ববর্তী কাঠামোতে পুনর্বহাল করা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, '১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা থাকতে হতো ২৫ শতাংশ। তবে পরবর্তী সরকারগুলো তাদের ভাগের পরিশোধিত মূলধন দিতে পারেনি, যার ফলে সরকারের মালিকানা প্রায় ৫-৮ শতাংশে নেমে আসে।'
'২০১১ সালে মুহাম্মদ ইউনূসকে যখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা হয়, তখন সরকার ব্যাংকে ২৫ শতাংশ মালিকানা পুনরুদ্ধারের জন্য তার মূলধন বাড়ায়,' বলেন তিনি।
গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩-তে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির ২৫ শতাংশ মালিকানা থাকবে সরকারের হাতে, আর ঋণগ্রহীতাদের হাতে থাকবে বাকি ৭৫ শতাংশ মালিক। প্রস্তাবিত সংশোধনীর আওতায়, ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হবেন।
ব্যাংকটির পরিশোধিত শেয়ার মূলধন ৩০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হবে। খসড়া অধ্যাদেশ অনুসারে, ঋণগ্রহীতা-শেয়ারহোল্ডাররা ৯০ শতাংশ মালিকানা পাওয়ার জন্য ধীরে ধীরে তাদের পরিশোধিত মূলধন বাড়াবেন। বোর্ড ঘোষিত যেকোনো লভ্যাংশ পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের অনুপাত অনুসারে বিতরণ করা হবে।
গ্রামীণ অধ্যাদেশ সংশোধন ছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ব্যাংক রেজোল্যুশন অর্ডিন্যান্স-এর খসড়া অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা, ব্যাংক লুটপাটকারীদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আদায় করা ও ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আনতে এই আইন প্রয়োগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একইসঙ্গে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আলাদা করার জন্য খসড়া অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) রাজস্ব আদায় বাড়াতে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। আইএমএফ থেকে নেওয়া ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের একটি শর্তও এটি।
আইএমএফ মনে করে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এই নতুন কাঠামো রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। দেশের ব্যবসায়ীরাও রাজস্ব কর্মকর্তাদের হয়রানি থেকে বাঁচতে এই দাবি করে আসছিলেন।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি একটি বিভাগ হবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আরেকটি বিভাগ হবে। এই দুটো বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কিছু সমন্বয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
এই দুই বিভাগের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি খাত থেকে চুক্তিতে জনবল নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে এই আইনে।
এছাড়া, টেলিফোন, ক্ষুদে বার্তাসহ যোগাযোগের অন্যান্য আধুনিক পদ্ধতিতে সমন জারি করতে পারবেন আদালত। দেওয়ানি কার্যবিধি বা সিপিসিতে এই বিধান যুক্তসহ আরও কিছু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।