নিজ খরচে চিকিৎসার বোঝা কমাতে ৯২% মানুষ চান, স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় বাড়ুক: বিবিএস জরিপ


স্বাস্থ্যখাতে সরকারের বরাদ্দ কম হওয়ায় চিকিৎসায় মানুষের ব্যক্তিগত খরচ বাড়ছে। তাই 'আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার' বা নিজ খরচে চিকিৎসার ব্যয়ভার কমাতে ৯২.১ শতাংশ মানুষ চান, স্বাস্থ্যখাতে সরকারের বরাদ্দের ভাগ বাড়ুক।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, ৮৭.৯ শতাংশ বাংলাদেশি চান স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হোক, যাতে করে সবাই স্বাস্থ্যসেবা পান।
এছাড়া দেশের ৯১.১ শতাংশ মানুষ চান, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক অধিকার হোক। জরিপে আরও দেখা গেছে, দেশের ৩৮ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা–অযত্ন বা অপচিকিৎসার শিকার হন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশিরা তাদের মোট স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ৭২.৫ শতাংশই নিজেরা বহন করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর তথ্যানুসারে, চিকিৎসার এই ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে সে বছর প্রায় ৬১ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মুখে পড়েছেন।
বিবিএস পরিচালিত এ জরিপে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ৬৪ জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের ৩৪৪টি নমুনা এলাকার ৮৫৬টি জনের মতামত নেওয়া হয়েছে। নমুনায়নের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী একজন নারী বা পুরুষের মতামত নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবু মোহাম্মদ জাকির হুসাইন বলেন, "স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতামত জানতে আমরা বিবিএসকে এ জরিপ করতে অনুরোধ করেছিলাম। জরিপে যেসব মতামত উঠে এসেছে, তার অনেক কিছুই আমাদের সুপারিশে আছে।"
ডাক্তার ও অস্ত্রোপচারের খরচ বেশি
জরিপে দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের ফি ও সার্জারি ফি বেশি মনে করেন যথাক্রমে ৫৭.৬ শতাংশ ও ৪৯.৬ স্বাতংশ মানুষ।
পল্লী এলাকায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কমপক্ষে একজন এমবিবিএস ডাক্তার থাকা উচিৎ বলে মনে করেন জরিপে অংশ নেওয়া ৯৭.৬ শতাংশ মানুষ।
পাশাপাশি শহর এলাকায় ওয়ার্ড স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করে সেখানে কমপক্ষে একজন এমবিবিএস ডাক্তার রাখা উচিৎ বলে মনে করেন ৯২.৭ শতাংশ মানুষ।
একজন চিকিৎসক একজন রোগীকে কমপক্ষে ১৫ মিনিট সময় নিয়ে দেখবেন বলে মনে করেন ২৫.২ শতাংশ মানুষ।
ড. আবু মোহাম্মদ জাকির হুসাইন বলেন, "প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্রি হবে। ২০ শতাংশ হত দরিদ্র মানুষ সব ধরনের সেবা বিনামূল্যে পাবেন।"
তিনি বলেন, "বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে আমরাও সুপারিশ করেছি। রাজনীতিবিদেরা বলেছেন, ৫ শতাংশ বাড়াবে। বাজেট যদি ৫ শতাংশ বাড়ানো যায়, তাহলে হয়তো সেবার মান বাড়বে। এর বাইরে আমাদের সোশ্যাল হেলথ ইন্সুরেন্স চালু করতে হবে। যারা ফরমাল সেক্টরে আছেন, তাদের এমপ্লয়ার ও এমপ্লয়ী কিছু দেবে। এই মডেলটা চালু হলে সরকারকে কিছু মানুষকে টাকা দিতে না হলে সেই টাকা গরিব মানুষ পাবেন।"
তিনি আরো বলেন, "সরকারি চাকরিজীবীরা যাতে রাজনীতি করতে পারেনা, সে বিষয়ে আইন আছে, সেটি কার্যকর করতে হবে। আমরা সুপারিশ করেছি, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা অফিস আওয়ারে যেতে পারবেনা।"
এছাড়া, স্বাস্থ্য বিমার কথা শোনেনি ৬১.৭ শতাংশ মানুষ। তবে স্বাস্থ্য বিমা চালু করা হলে মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে বিমায় অংশ নিতে ইচ্ছুক ৭১.১ শতাংশ মানুষ।
জরিপে আরও দেখা গেছে, ৭৬.৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, স্বাস্থ্য সেবার সাথে সম্পৃক্ত ডাক্তার, মেডিকেল শিক্ষক ও স্বাস্থ্য সেবাকারীদের নিজ কর্মস্থলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত।
ঔষধ, সেবা
এদিকে, এমবিবিএস ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রি করা সমর্থন করেনা ৬৮.৩ শতাংশ মানুষ।
ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা ডাক্তারের চেম্বার ভিজিট করে ওষুধ সম্পর্কে তথ্য দেন, প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখতে অনুরোধ করেন— এ বিষয়টি সমর্থন করেন না ৬৫.৮ শতাংশ মানুষ।
ড. আবু মোহাম্মদ জাকির হুসাইন বলেন, "সেবা প্রদানকারী যাতে মিনিমাম ১০ মিনিট সময় দেন, সে বিষয়ে আমরা সুপারিশ করেছি। যদিও জরিপে গড়ে ২০ মিনিট করে সময় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে আমাদের যে জনবল তাতে ১০ মিনিটও সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তারপরও আমরা ১০ মিনিট বলছি, কারণ আমরা বলছি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকে স্ট্রেনদেন করবো, এটি হলে মানুষ ডিস্ট্রিক বা টারশিয়ারি কেয়ার হাসপাতালে ভিড় করবেনা।"
বিদেশে চিকিৎসা
জরিপে উঠে এসেছে জাতীয় পর্যায়ে মাত্র ২.৪ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যান, যেখানে ৯৭ শতাংশ মানুষ দেশের মধ্যেই চিকিৎসা নেন। শহর এলাকার মানুষ (৪.১%) পল্লী এলাকার মানুষের (১.৬%) তুলনায় বেশি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান।
জরিপে দেখা গেছে, চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া রোগীদের মধ্যে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের অনুপাত সবচেয়ে বেশি (২৯.৪%)। এরপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ক্যান্সার (১৪.৮%), কিডনি রোগ (১৩.৫%), ডায়াবেটিস (৭.৬%), সড়ক/অগ্নিদুর্ঘটনা (৬.৮%), নিউরোলজি (৫.৫), বন্ধ্যাত্ব (৩.৮%) ইত্যাদি।
এছাড়াও, অন্যান্য রোগের মধ্যে নাক-কান-গলা সমস্যা, গ্যাস্ট্রোলিভার, লিভার সিরোসিস, গাইনি (জরায়ু) সমস্যা, এলার্জিজনিত সমস্যা, পেপটিক আলসার, আইবিএস, হার্নিয়া সার্জারি, পিত্তথলিতে পাথর ইত্যাদি রোগের জন্যও বিদেশ গিয়েছেন অনেকে।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন বলেন, "আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, যেসব রোগে রোগীরা বিদেশে যায় সেসব রোগের চিকিৎসা সরকারি, বেসরকারি বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে দেশেই ব্যবস্থা করতে হবে।"
"যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসব রোগের চিকিৎসা দেয় তাদের ভ্যাট-ট্যাক্স ফ্রি করে দিতে হবে, যাতে তারা কম দামে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারে এবং রোগীদের সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা দিতে পারে। এতে একদিকে রোগীদের বিদেশমুখিতা কমবে, অন্যদিকে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হবে," যোগ করেন তিনি।