লাইটার জাহাজে সমুদ্রে পণ্য গুদামজাতের সিন্ডিকেট ঠেকাতে সরকারের চেষ্টা যেভাবে আইনি বাধায় হোঁচট খায়

আমদানি করা বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গভীর সমুদ্রে নোঙর করা মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে লাইটার (ছোট) জাহাজের মাধ্যমে বন্দর বা গুদামে পরিবহন করা হয়। আর বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগায় একদল অসাধু ব্যবসায়ী।
তারা লাইটার জাহাজে পণ্য বোঝাই করার পর সরবরাহ না করে সেগুলো দিনের পর দিন সমুদ্র বা নদীতে ভাসিয়ে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
অস্থিরতার মাধ্যমে বাজারদর বাড়ানোর পর ওইসব লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে তারা। এর মাধ্যমে জনগণের পকেট কেটে তারা বিপুল মুনাফা করে।
সরকার দীর্ঘদিন ধরে পণ্যবাহী লাইটার জাহাজ কতক্ষণ পানিতে থাকতে পারবে, তার সময়সীমা নির্ধারণের নীতিমালা প্রণয়ন করে এই চর্চা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে লাইটার জাহাজের মালিকদের একটি অংশ এবং কিছু আমদানিকারকদের বিরোধিতার কারণে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
সিন্ডিকেটের এই দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে ২০১৩ সালে নৌপরিবহন অধিদপ্তর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং পরিবহন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) গঠন করে।
এই সেলের দায়িত্ব ছিল মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের পণ্য আনা-নেওয়ার সিরিয়াল বজায় রাখা, শিপমেন্ট বরাদ্দ দেওয়া, ভাড়া নির্ধারণ ও কতদিনের মধ্যে খালাস করবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করার।
এই নীতিমালা পালন বাধ্যতামূলক করে ২০২১ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গেজেট জারি করে। কিন্তু এরপর লাইটার জাহাজ মালিক ও আমদানিকারকরা হাইকোর্টে রিট করে সেই গেজেটের কার্যকরিতা স্থগিত করে।
সরকার সেটির বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখায় নীতিমালা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
গত বছরের ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটি নতুন নীতিমালা চালু করা হয়। নতুন নীতিমালা অনুসারে, মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসের পর লাইটার জাহাজগুলোকে দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে পণ্য খালাস করে বন্দর বা গুদামে পৌঁছে দিতে হবে।
তবে লাইটার জাহাজ মালিক এবং কিছু আমদানিকারক এটি বন্ধ করার জন্য আবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে।
যেভাবে কাজ করে এ সিন্ডিকেট
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে করে প্রতি বছর ১০ কোটি টনের বেশি পণ্য ৪০টি অভ্যন্তরীণ নৌপথে পাঠানো হয়। ১ হাজার ৪০০-র বেশি লাইটার জাহাজ পরিবহনের কাজ করে।
কো-অর্ডিনেশন সেল ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, এর মধ্যে অনেকগুলো জাহাজ প্রায়ই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার জন্য দিনের পর দিন পণ্য খালাস না করে সমুদ্রে ভাসতে থাকে। রমজান মাসে যখন কিছু নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে, তখন এই কাজ বেড়ে যায়।
সেলের ১৫ জানুয়ারির তথ্য বলছে, ৮৭৬টি লাইটার জাহাজ মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লোড করার পর সেগুলো খালাস না করে অলস বসে ছিল সমুদ্রে। জাহাজগুলোতে চিনি, ডাল, ভোজ্যতেল, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল ছিল। এসব পণ্য বোঝাই করে একেকটি জাহাজ ৩০ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত বসে ছিল।
আইনি লড়াই: সরকারের নীতিমালা ও জাহাজ মালিকদের বিরোধিতা
সরকার ২০১৩ সালে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন নিয়ন্ত্রণের নীতিমালা প্রণয়ন করলেও কিছু লাইটার জাহাজ মালিক ও আমদানিকারক কোনোভাবেই তা মেনে চলেনি।
এই নীতিমালা পালন বাধ্যতামূলক করে ২০২১ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি গেজেট জারি করে। এরপর হাইকোর্টে রিট করে সেই গেজেটের কার্যকরিতা স্থগিত করা হয়। সরকার সেটির বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখায় নীতিমালা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ওই নীতিমালা নতুন করে প্রণয়ন করে এবং বাধ্যতামূলক করে। এবারও লাইটার জাহাজ মালিক ও আমদানিকারকরা এই নীতিমালা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে নীতিমালা স্থগিত করে নেয়। পরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আপিল বিভাগে আপিল করে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করেন।
সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে গত নভেম্বরে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে ১৭টি লাইটার জাহাজ কোম্পানি ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।
গত ২ ডিসেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি শিকদার মাজমুদ রাজির হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সরকারপ্রণীত নীতিমালা স্থগিত করেন। একইসঙ্গে এই নীতিমালা কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
পরবর্র্তীতে নৌপরিবহন অধিদপ্তর হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করে। সেখান থেকে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় আপিলটি।
গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগ আপিল নিষ্পত্তি করে চেম্বার জজের আদেশ বহাল রাখেন। একইসঙ্গে হাইকোর্টের জারি করা রুল দুই সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন।
শুনানির সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান আদালতে বলেন, এই নীতিমালার কারণে বাজার অরাজকতা, একচেটিয়া, বিশৃঙ্খলা এবং কায়েমী স্বার্থ থেকে মুক্ত হয়েছে।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, বাণিজ্যে শৃঙ্খলা আনা ও সমান প্রতিযোগিতার জন্য নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
নীতিমালার বিরুদ্ধে লাইটার জাহাজ মালিকদের যুক্তি
একচেটিয়া আধিপত্য তৈরির সম্ভাবনা নেই। পর্যবেক্ষণ কমিটি নতুন সংগঠনের কার্যক্রম তদারকি করবে। সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অভাবে জাহাজ মালিকদের একাংশ কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করেছেন।
এই নীতিমালা বাতিল চেয়ে করা রিটে বলা হয়েছে, নতুন নীতিমালাটি লাইটার জাহাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, যার মূলে রয়েছে একটি ছোট সিন্ডিকেটের স্বার্থ। এর উদ্দেশ্য প্রতিযোগিতাকে দমন করে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের আর্থিক মুনাফা নিশ্চিত করা।
এতে আরও বলা হয়েছে, এই 'দুর্নীতিগ্রস্ত' কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কো-অর্ডিনেশন সেল। এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ভূমিকার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে এই সেল। সেলটি বেসরকারি ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ফি দিতে বাধ্য করে।
আবেদনকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সামিউল হক টিবিএসকে বলেন, নীতিমালাটির কার্যকারিতা এখন হাইকোর্টের ওপর নির্ভর করছে।
তবে হাইকোর্টে রায় নীতিমালার পক্ষে-বিপক্ষে গেলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবে বলে জানিয়েছে অ্যটর্নি জেনারেল অফিস।
কো-অর্ডিনেশন সেল যা বলছে
সেলের কনভেনার সাঈদ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, হাইকোর্ট নীতিমালা স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিলে নীতিমালা বাস্তবায়ন বন্ধ হয়। পরে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। এরপর থেকে কো-অর্ডিনেশন সেল লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সেটি প্রায় একমাস ধরে চলছে।
তিনি বলেন, নীতিমালাটি মূলত লাইটার পরিবহন নিয়ন্ত্রণের জন্য করা, যাতে স্বচ্ছ ও সুশৃ্ঙ্খল উপায়ে পণ্য বাজারজাত সম্ভব হয়। পাশাপাশি কারখানার কাঁচামাল দ্রুত সরবরাহ সম্ভব হয়।
সাঈদ আহমেদ আরও বলেন, জানুয়ারিতে প্রায় ৯০০ লাইটার জাহাজ গুদাম হিসেবে সমুদ্রে আটকা ছিল। এখন এ সংখ্যা কমে এসছে।
নতুন নীতিমালা যেভাবে কার্যকর হবে
নতুন নীতিমালা অনুসারে, এখন থেকে লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠনগুলো কো-অর্ডিনেশন সেলের অধীনে পরিচালিত হবে। লাইটার জাহাজ বরাদ্দে মালিক, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, পণ্যের এজেন্ট, লোকাল এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সমন্বয়কারক হিসেবে কাজ করবে সেল।
সেলের কার্যক্রম মনিটরিং করতে ১০ সদস্যের তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি থাকবেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তার প্রতিনিধি।
নীতিমালা অনুযায়ী, কো-অর্ডিনেশন সেলের বরাদ্দ ছাড়া কোনো লাইটার জাহাজ মাদার ভেসেল থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারবে না। তবে শর্তসাপেক্ষে, যেমন যে কারখানা ও গ্রুপ অভ কোম্পানির নিজস্ব লাইটার জাহাজ রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের অব্যাহতিপত্র সাপেক্ষে তাদের পণ্য নিজস্ব জাহাজে পরিবহনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।