টিসিবি, ওএমএস পণ্যের চাহিদা বাড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা

সোমবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের কাছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে শত শত মানুষ টিসিবির ট্রাক থেকে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার আশায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ সেখানে জড় হন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সকাল ৮টা থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও ট্রাকটি তখনো পৌঁছায়নি।
রিকশাচালক মো. জামশেদ আলী সোমবার খালি হাতে ফিরে যাওয়ার হতাশা নিয়েই বুধবার আবার সেখানে আসেন। তিনি বলেন, 'পরশুদিন এসেছিলাম, কিন্তু লাইন অনেক বড় ছিল।'
জামশেদ বলেন, 'আজকে আধাঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি, এখনো গাড়ি আসেনি। এখান থেকে কিনলে খরচ কিছুটা বেঁচে যায়।'
প্রায় দুপুরের দিকে ট্রাকটি অবশেষে এসে পৌঁছালে, ক্রেতারা টোকেন সংগ্রহ করে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা লাইনে দাঁড়ান। প্রতি লাইনে ১০০ জনকে ট্রাক থেকে পণ্য কেনার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে বিকেল সাড়ে ৩টার মধ্যেই চাহিদা সেই সীমা পার করে যায়।
৭০ বছর বয়সী আবু বকর সিদ্দিক লাইনে ৮০তম অবস্থানে ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি এখানে তিন ঘণ্টা ধরে আছি। রমজান মাস চলছে, রোদে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর।'
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের এই দৃশ্য ঢাকার কারওয়ান বাজার ও রামপুরাসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও দেখা গেছে।
টিসিবির ট্রাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তুলনামূলকভাবে কম দামে বিক্রি করা হয়। ভোজ্যতেল প্রতি লিটার ১০০ টাকা, ডাল প্রতি কেজি ৬০ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ৭০ টাকা, ছোলা প্রতি কেজি ৬০ টাকা এবং ৫০০ গ্রাম খেজুর ১৫৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বাজারদরের চেয়ে প্রায় ৪০০ টাকা কমে এসব পণ্য কিনতে পারেন ক্রেতারা।
বর্তমানে টিসিবি সারাদেশে ৪১০টি ট্রাকসেলে পণ্য বিক্রি করছে, যার মধ্যে ঢাকায় ৫০টি ও চট্টগ্রামে ২০টি ট্রাক রয়েছে। এর বাইরে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৬৩ লাখ পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে টিসিবি।
চাহিদা বাড়ার প্রসঙ্গে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, 'নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ট্রাকসেল চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ফ্যামিলি কার্ড হালনাগাদ চলছে। আমরা চেষ্টা করছি মানুষের স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে।'
একই চিত্র অন্য জেলাগুলোতেও
খুলনায় ভর্তুকি মূল্যের পণ্যের সংকটে অনেক মানুষ খালি হাতে ফিরেছেন।
সাবরিনা বেগম বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়ে সকাল ১১টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুপুর ২টায় যখন তার পণ্য নেওয়ার পালা আসে, তখনই জানা যায়, সব মালামাল শেষ।
তিনি বলেন, 'একটু কম দামের আশায় এখানে পণ্য কিনতে এসেছিলাম। তবে এত ভিড় আর হট্টগোলের কারণে ট্রাক থেকে পণ্য নিতে পারলাম না।'
বগুড়ায় ডলি বেগম অসুস্থ স্বামীকে বাড়িতে রেখে সকাল ৮টায় জেলখানা মোড়ে লাইনে দাঁড়ান। দুপুর আড়াইটায় ডিলার ঘোষণা দেন, সব পণ্য শেষ। এতে ২৫০ জনের বেশি মানুষ পণ্য ছাড়াই ফিরে যান।
ডলি বেগম বলেন, 'সরকার যদি পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে সেটা জানানো উচিত। রমজানের এই সময়ে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক নয়।'
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বগুড়ায় প্রতিদিন পাঁচটি টিসিবি ডিলার ৪০০ জন করে ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ প্রায়ই কম থাকে।
জাহিন ট্রেডার্সের সুপারভাইজার আব্দুল কফি বলেন, 'আজ প্রায় দেড় থেকে ২ হাজার মানুষ এসেছেন পণ্য কিনতে। কিন্তু আমাদের কাছে মাত্র ৪০০ জনের জন্য পণ্য ছিল।'
দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় টিসিবি ও ওএমএস পণ্যের দীর্ঘ লাইনে নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে।
হতদরিদ্ররা এখনও কার্ডের আওতায় আসেনি
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর উভূতি গ্রামের ৬০ বছর বয়সী আলেয়া বেগম কয়েক বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
বয়সজনিত কারণে চলাফেরায় অক্ষম আলেয়া বেগম ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন। বারবার চেষ্টা করেও তিনি টিসিবির কার্ড পাননি, যা তাকে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সুযোগ দিত।
তিনি বলেন, 'আমার জন্য কি একটি কার্ডও হবে না?' তার এই হতাশার সুর গ্রামটির আরও অনেকের কষ্টের প্রতিধ্বনি।
তাদের মধ্যে আছেন রিকশাচালক জাহাঙ্গীর, ৪০ বছর বয়সী বিধবা জুলেখা বেগম এবং ৪৫ বছর বয়সী কৃষক আবদুজ জাহের। তাদের কেউই টিসিবির পণ্য কিংবা অন্য কোনো সরকারি সহায়তা পাননি।
তারা অভিযোগ করেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য তাদের জানিয়েছেন, কার্ডের জন্য বরাদ্দকৃত কোটার সংখ্যা পূর্ণ হয়ে গেছে।
ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. লিটন বলেন, 'জনসংখ্যা বেশি থাকলেও কার্ডের সংখ্যা কমে গেছে।'
তিনি বলেন, 'আমার ওয়ার্ডে প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দা এবং ৭ হাজারের বেশি ভোটার রয়েছে। আগে ২৫০টি টিসিবি কার্ড ছিল, কিন্তু স্মার্ট সিস্টেম চালুর পর তা কমে ২৪০টিতে নেমে এসেছে।'
লিটন আরও বলেন, 'আমি কাকে বাদ দেব, সেটা কীভাবে ঠিক করব? সরকারের উচিত জনসংখ্যার ভিত্তিতে কার্ড বরাদ্দ দেওয়া।'
অন্য ইউপি সদস্য মো. মিজানুর রহমানও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, তার ওয়ার্ডের জনসংখ্যা ২ হাজার হলেও, কার্ডের সংখ্যা একই, ২৫০টি।
এই দুই জনপ্রতিনিধি সরকারের কাছে সহায়তা আরও সুষমভাবে বণ্টনের দাবি জানান।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, তিন থেকে পাঁচটি স্থানে মোবাইল ট্রাকের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য বিক্রি করা হয়। তবে অনেক বাসিন্দা, বিশেষ করে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীরা এই পণ্য পেতে যথেষ্ট ভোগান্তির শিকার হন।
সুলভ মূল্যে মাংস, দুধ বিক্রি চালু রয়েছে
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় রাজধানীর ৭০টি স্থানে ওএমএস ট্রাকের মাধ্যমে চাল ও আটা বিক্রি করছে। চালের দাম প্রতি কেজি ৩০ টাকা এবং আটা প্রতি কেজি ২৪ টাকা। বাজারে দাম বাড়ার কারণে এসব ট্রাকের সামনে বড় ধরনের ভিড় দেখা যাচ্ছে। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি করে চাল ও আটা কিনতে পারেন।
রমজানে খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও ২৫টি স্থানে ভর্তুকি মূল্যে মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রি করছে।
প্রতি কেজি ড্রেসড ব্রয়লার মুরগির দাম ২৫০ টাকা, পাস্তুরিত দুধ প্রতি লিটার ৮০ টাকা, এক ডজন ডিম ১১৪ টাকা এবং গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা। পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি এই উদ্যোগ শুরু হয়।
তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্য বিক্রির শুরুতেই দুই ঘণ্টার মধ্যে সব কিছু শেষ হয়ে যায়। ফলে অনেক ক্রেতা খালি হাতে ফিরে যান।
রাজধানীর খামারবাড়ি বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন মো. জামালউদ্দিন। তিনি বলেন, 'শুনেছিলাম কম দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু দুপুরে এসে দেখি, সব শেষ।'
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ৬০ হাজার ডিম, ৬ হাজার লিটার পাস্তুরিত দুধ, ২ হাজার কেজি ব্রয়লার মুরগি এবং আড়াই হাজার কেজি পর্যন্ত গরুর মাংস বিক্রি করা হয়।
আমাদের লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি সানা উল্লাহ সানু, খুলনা প্রতিনিধি আওয়াল শেখ, রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।