অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব: আলী রীয়াজ

প্রধান সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
আজ সোমবার (১০ মার্চ) জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন সম্ভব। বাংলাদেশে এর আগেও অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। নির্বাচিত সংসদ পরবর্তীতে সেটির অনুমোদন দিয়েছে।"
আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ৩৪ টি দল ও জোটের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, "দলগুলোর কাছ থেকে তাদের মতামত প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করবো। এজন্য এখনো পর্যন্ত আমরা কোন সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করিনি। যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে সেই সময় থেকেই আলোচনার শুরু হবে।"
রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোর প্রতি যত দ্রুত সম্ভব মতামত জানাতে অনুরোধ জানান তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, "এই প্রক্রিয়ার পরের ধাপ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই দ্রুত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি 'জাতীয় সনদ' তৈরি করতে।"
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্যে গঠিত ছয়টি কমিশন ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনগুলো সরকারের কাছে জমা দেয়।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই ছয়টি কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং পদক্ষেপ সুপারিশের উদ্দেশ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি ড. ইউনুসকে সভাপতি এবং আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন– বদিউল আলম মজুমদার, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক এবং ইফতেখারুজ্জামান।
এই কমিশনের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ছয় মাস।
কমিশনের কাজে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে সাংবাদিক মনির হায়দারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
আলী রীয়াজ জানান, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এই কমিশন কাজ শুরু করে। কমিশনের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সৌজন্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ৩৪টি দলের মোট ১০৪ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
সভায় উপস্থিত সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে তাদের সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, "সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের হার্ড কপি ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। ইতঃপূর্বে সব দলকে প্রতিবেদনগুলোর সফট কপিও পাঠানো হয়।"
আলী রীয়াজ জানান, এরপরে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তিন দফা বৈঠক করেন এবং সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোকে চিহ্নিত করেন।
আলী রীয়াজ বলেন, "পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহকে ছকের আকারে বিন্যস্ত করা হয়। এইসব ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যুক্ত করা হয়নি। পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে, তাদের সুপারিশসমূহ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।"
তিনি বলেন, "এই ছকসমূহ ৬ মার্চ ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এতে মোট সুপারিশের সংখ্যা হচ্ছে ১৬৬টি। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি।"
তিনি আরও বলেন, "প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো– সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো– 'একমত', 'একমত নই' এবং 'আংশিকভাবে একমত'। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।"
তিনি জানান, দ্বিতীয়টি হলো– প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এই ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো 'নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে', 'নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে', 'নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে', 'গণপরিষদের মাধ্যমে' 'নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে' এবং 'গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে'। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর 'মন্তব্য' দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।
আলী রিয়াজ বলেন, "আমরা আশা করছি, আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো তাঁদের মতামত আমাদেরকে জানাবেন। ইতিমধ্যে যদি কোনও প্রশ্ন থাকে বা ব্যাখ্যার দরকার হয়, তবে কমিশন সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে সব সময় প্রস্তত আছে।"
লিখিত বক্তব্যে আলী রীয়াজ জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ব্যাপারে নাগরিকদের মতামত জানার জন্যে খুব শিগগিরই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হবে।