শীত হারাল উষ্ণতায়? ১৯৪৮ সালের পর বাংলাদেশে উষ্ণতম মৌসুমের রেকর্ড

১৯৪৮ সালের পর, এবার সবচেয়ে উষ্ণ শীতকাল (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) দেখল বাংলাদেশ। দেশে সবচেয়ে শীতল মাস হিসেবে পরিচিত জানুয়ারিতে এবার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তাপ রেকর্ড করা হয়েছে। অন্যান্য বছর জানুয়ারিতে গড়ে দুই থেকে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ হলেও এ বছর কোনো শৈত্যপ্রবাহ বা তীব্র ঠান্ডা দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)।
"এবারের শীতকাল উত্তপ্ত ছিল এবং শীতের অনুভূতিও খুব বেশি ছিল না। ১৯৪৮ সাল থেকে বিএমডির রেকর্ডকৃত তাপমাত্রার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ সাল পর্যন্ত জানুয়ারিতে ২ থেকে ৩টি তীব্র শৈতপ্রবাহ হয়ে থাকে। কিন্তু এবারে একটিও হয়নি," বলেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
২০২৪ সাল ছিল বিশ্বব্যাপী রেকর্ডকৃত ইতিহাসের উষ্ণতম বছর এবং বৈশ্বিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালেও একই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, তাপমাত্রা আগেভাগেই বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি মার্চ মাসে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে দুটি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ সময় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত এবং তীব্র কালবৈশাখী ঝড়ের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে আরও বলেন, "২০২৪ সাল ছিল উত্তপ্ত বছর, কিন্তু এবারের জানুয়ারিকে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস বলা হচ্ছে। একইসাথে ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল।"
তিনি বলেন, "আগের বছরগুলোতে ফেব্রুয়ারিতে বজ্রঝড়, কালবৈশাখী হয়ে থাকে। কিন্তু এবারে এমন কিছু ঘটেনি। এবারের শীতকাল উত্তপ্ত ছিল। যার অন্যতম কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং মানবসৃষ্ট কারণ।"
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, "বাংলাদেশে শীতকাল শেষ হতে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে যায়। সাধারণত ১০ তারিখ পর্যন্ত শীতের অনুভূতি থাকে, কিন্তু এবারে এমনটা হয়নি।"
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "এবারের শীতকালে শীতল অনুভূতি কম থাকার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর আকাশে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি ছিল। পূবালী বাতাসের প্রভাবে গরম বাতাস দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহমান ছিল। এতে কুয়াশার ঘনত্ব ও পুরুত্ব কম থাকার কারণে শীত ঝেঁকে বসতে পারেনি।"
বাংলাদশে সাধারণত সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে জানুয়ারি মাসে; এ সময় ১-৩টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়। তবে এবার জানুয়ারি কেটেছে মাত্র একটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। আর ফেব্রুয়ারিতে কোনো শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। অনেকটা অস্বাভাবিক উষ্ণ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে এই সময়ে।
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা টানা তিন দিন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকলে সে আবহাওয়াকে মূলত শৈত্যপ্রবাহ বলে।
শৈত্যপ্রবাহ চার ধাপে বিভক্ত: মৃদু শৈতপ্রবাহে তপমাত্রা ৮.১–১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে; মাঝারি শৈতপ্রবাহে ৬.১–৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তীব্র শৈতপ্রবাহে ৪.১–৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং অতি তীব্র শৈতপ্রবাহে তপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে কেবল একটি মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে। এটি হয়েছিল ১০ জানুয়ারির দিকে। তখন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এ নেমে এসেছিল ৭.৩ ডিগ্রি সেলোসিয়াসে। ফেব্রুয়ারিতে সর্বনিম্ন রেকর্ডকৃত তাপমাত্রা ছিল ৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলে দেখা গিয়েছিল এই তাপমাত্র।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারির গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সাধারণত ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। তবে এ বছর, জানুয়ারিতে গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩.৬ সেলসিয়াস। যদিও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এ তপমাত্রা ছিল ১২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এবার ফেব্রুয়ারির গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল; এ সময় দেশের গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় ৭৭ শতাংশ কম ছিল।
বলা যায়, এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কোনো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। অন্যদিকে, ২০২৪ সালে ৪টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, ২০২৩ সালে একটি এবং ২০২২ ও ২০২১ সালে ৩টি করে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল বাংলাদেশে।
মার্চ মাসে ১-২টি মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও মাঝারি তাপপ্রবাহ (৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমেনুল ইসলাম মার্চ ২০২৫-এর দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়া পূর্বাভাসে এ তথ্য জানিয়েছেন।
পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, ২-৩ দিন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বজ্রঝড় ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে এবং একদিন তীব্র বজ্রঝড় হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া, স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হতে পারে, এবং বঙ্গোপসাগরে কোনো ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
কী বলছে বৈশ্বিক আবহাওয়ার তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস?
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের দুর্বল লা নিনা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে ৬০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে যে, পরিস্থিতি আবার ইএনএসও–নিরপেক্ষ (এল নিনো বা লা নিনা কোনোটিই নয়) অবস্থায় ফিরে যাবে। এ পরিস্থিতি ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে বেড়ে ৭০ শতাংশও হতে পারে।
ডব্লিউএমও জানিয়েছে, ২০২৪ ছিল ইতিহাসে রেকর্ডকৃত উষ্ণতম বছর—যা প্রথমবারের মতো প্যারিস চুক্তির নির্ধারিত প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার সীমা অতিক্রম করে। এই উষ্ণায়নের প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, এল নিনোর সম্ভাবনা কম থাকলেও দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বিশেষ করে বসন্তকালীন পূর্বাভাসের সীমাবদ্ধতার কারণে। আবার লা নিনা পরিস্থিতি দুর্বল থাকা সত্ত্বেও ২০২৫ সালের জানুয়ারি ছিল উষ্ণতম মাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. রাবিউল আউয়াল বলেন, তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আশা থাকলেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে শীত কম পড়েছে।
তিনি বলেন, "এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহ তীব্র হতে পারে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, যেখানে সবুজ গাছপালা কম, সেখানে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।"
'আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা' পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এখনকার 'শীতকাল' অতীতের 'গরমকাল' এর তুলনায়ও বেশি উষ্ণ। ১৯৭৪ সালে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা প্রায় ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছিল, এবং ২০২৪ সালের মধ্যে এটি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালও ২০২৪ ও ২০২৩ সালের পর অন্যতম উষ্ণ বছর হতে পারে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল বা আইপিসিসি জানিয়েছে, লা নিনার শীতল প্রভাব থাকলেও চরম তপমাত্রা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়; বিশেষ করে এশিয়ায়, যেখানে তাপপ্রবাহের তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে এবং শীত কমে আসছে।