অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও কমে ৬.২৩ শতাংশে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালের অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.২৩ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৬.২৯ শতাংশ; অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে তা সামান্য কমেছে। এক বছর আগে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছিল ৮.৩০ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির টানা নিম্নমুখী প্রবণতাকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, গত বছরের আগস্ট থেকে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত ঋণ প্রবাহের এই নিম্নগতি।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সম্প্রসারণে অনাগ্রহী হওয়ায় মূলধনি যন্ত্রপাতির চাহিদাও কমে গেছে, যার প্রভাবে কমেছে ঋণ নেওয়া। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে বর্তমানে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নতুন বিনিয়োগে দুর্বলতা। নতুন বিনিয়োগ না করা হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা কমে যায়। তখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমে যায়। বিনিয়োগে কোনো ঘুরে দাঁড়ানোর সিগন্যাল নেই। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে ধরে নিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, তিনি আরও যোগ করেন, আগে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়ার যে প্রবণতা ছিল, তা এখন কমেছে। পাশাপাশি আগে ডলার সংকটের কারণে আমদানি দায় মেটানোতে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, তা-ও কিছুটা কেটে গেছে।
'তবে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি সংকট। অনেক কারখানা গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে প্রায় ৯.৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণে অর্থের একটি বিশাল অংশ আটকে থাকায় অনেক ব্যাংক আর্থিক চাপে রয়েছে, নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা এখন বেশ সতর্ক।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অভ বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, 'নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে স্থবিরতা হচ্ছে। কারণ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা কমেছে। নতুন বিনিয়োগ হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে ব্যবসা সম্প্রসারণের সেই অবস্থা নেই।'
এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, কিছু ব্যাংক তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির চাপে রয়েছে। এতে তাদের নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ও আগ্রহ কমছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ঋণের চড়া সুদহারও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা আরও বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ব্যবসায়িক বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। ব্যবসায়ীরা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যায় এবং স্বচ্ছতা ফিরে আসে কি না, তা দেখার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছেন।
তৌহিদুল বলেন, 'বেসরকারি খাতে ঋণের এই মন্থরগতির কারণ হলো ঋণের চাহিদা ও জোগান উভয়ই একসঙ্গে কমে যাওয়া। চাহিদার দিক থেকে দেখলে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন, ফলে নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে।'
আশিকুর রহমান বলেন, 'আগামী তিন মাস আসলে নতুন বিনিয়োগ তেমন হবে না। কারণ রাজনৈতিক সরকার আসার পর অনেক কিছু নির্ধারণ হবে। পরিবেশের কি উন্নতি হবে, নাকি তারা আগের নিয়মে, খেলবে সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কারণ অর্থনীতি এখন একটা কঠিন বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে।'
ঋণের গতি ফিরিয়ে আনতে ব্যাংক ও ব্যবসায়িক খাতের স্থিতিশীলতা ও আস্থার ওপর জোর দেন তৌহিদুল। তিনি বলেন, প্রথমত ও প্রধানত, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং একটি অনুমানযোগ্য নীতি কাঠামো অত্যন্ত জরুরি, যাতে উদ্যোক্তারা নিশ্চয়তার সাথে পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ করতে পারেন।"
'পাশাপাশি, সুশাসন জোরদার করা, খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং প্রয়োজনীয় তারল্য সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এতে ব্যাংকগুলো আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে এবং প্রতিযোগিতামূলকভাবে ঋণ দিতে সক্ষম হবে,' বলেন তিনি।
বিনিয়োগের 'উপযুক্ত পরিবেশ নেই'
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ব্যবসা সম্প্রসারণ তো দূরের কথা, বর্তমান কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ দুটি প্রধান উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন—আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জ্বালানি সংকট।
তিনি আরও বলেন, আগামী দুই বছরেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
'জাতীয় নির্বাচনের পর বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হতে দেড় বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়, সেখানে কোন ভরসায় ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করবেন?' বলেন তিনি। এমন পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তাসকিন বলেন, 'বর্তমানে জ্বালানি সংকটই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অনেক জায়গাতেই গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই।'
এদিকে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'ব্যাংকঋণের সুদের হার অনেক বেশি। এত চড়া সুদে ব্যবসা পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।'
আয়ের জন্য সরকারি সিকিউরিটিজের দিকে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো এসব খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকছে।
প্রথাগত ব্যাংকগুলোর আয়ের একটি বড় অংশ এখন আসছে এই ধরনের বিনিয়োগ থেকে।
যদিও ২০২৫ সালের শুরুতে আমানতের সুদহার বৃদ্ধি, বিরাজমান মূল্যস্ফীতি, ঋণের চাহিদা কম থাকা, কমে আসা মুনাফার মার্জিন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল, কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টোটা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো, বিশেষ করে শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়েছে। তবে এই মুনাফা ঋণ বিতরণের মাধ্যমে আসেনি, বরং এসেছে সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে অর্জিত বিপুল আয় থেকে। এটি এখন খাতটির জন্য নতুন লাইফলাইন হয়ে উঠেছে এবং ব্যাংকের ব্যালান্স শিটের ধরনই বদলে দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্র্যাক ব্যাংকের বিনিয়োগ আয় ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যেখানে ছিল ৭০০-৮০০ কোটি টাকার মতো, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা—যা প্রায় চার গুণ বেশি।
