কেন স্বর্ণের দাম এত বাড়ছে?
সোনার কেনাবেচার জগতের ভাষাটা অনেকটা পোকার খেলার ভাষার মতো।
এখানে 'শক্তিশালী হাত' বলা হয় সেইসব বিনিয়োগকারীদের, যারা দাম যাই হোক না কেন, সোনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন। আর 'দুর্বল হাত' হলো সেইসব অস্থায়ী বিনিয়োগকারী, যারা বিপদের সামান্য আঁচ পেলেই খেলা ছেড়ে দেন বা সরে পড়েন।
যারা দাম বাড়ার পক্ষে বাজি ধরেন, তারা তখনই জেতেন যখন তারা অন্যদেরকে নিজেদের গল্পটা বিশ্বাস করাতে পারেন। তাদের গল্পের মূল কথাটি হলো, কেন এবার শক্তিশালী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দুর্বলদের চেয়ে বেশি। কিন্তু বাজার যেই নরম হতে শুরু করে, তখনই তাদের এই চালাকি বা ধাপ্পাটা ধরা পড়ে যায়। যদি দাম আর না বাড়ে, তাহলে তাদের গল্পটা ভেঙে যায়। আর যদি দাম আবার বাড়ে, তাহলে তাদের গল্পের ওপর সবার বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়।
এই বছর সোনার বাজারে বিনিয়োগকারীরা এতটাই আরামে জিতছেন যে, মনে হচ্ছে সব তর্ক শেষ।
গত ২০শে অক্টোবর সোনার দাম আউন্সপ্রতি রেকর্ড ৪ হাজার ৩৮০ ডলারে পৌঁছায়। এরপর এর দাম ১০ শতাংশেরও বেশি কমে গিয়েছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই সেই ক্ষতি পুষিয়ে দাম আবার বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে সোনার দাম এই বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি। এমনকি ১৯৮০ সালের সর্বোচ্চ দামের চেয়েও (মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করে) ৪৭ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৬ সালের শেষে সোনার দাম ৫ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অথচ মজার ব্যাপার হলো, এই বছরের শুরুতে কেউই ভাবেনি যে ২০২৫ সালের মধ্যেই দাম ৪ হাজার ডলার ছাড়াবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, দাম বাড়ার পেছনের এই তত্ত্বগুলো কতটা সত্যি?
এর পেছনে মূলত তিনটি ভিন্ন ক্রেতা গোষ্ঠীর তত্ত্ব রয়েছে: প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পূর্বানুমানকারী।
সবার আগে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কথা ভাবা যাক। সোনার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, এটি সংকটের সময়ে একটি নির্ভরযোগ্য 'মূল্যের ভাণ্ডার' হিসেবে কাজ করে। এটি একটি বাস্তব জিনিস, যা সহজে বহন করা যায় এবং এর নির্দিষ্ট আকারের বার বিশ্বজুড়ে কেনাবেচা হয়। এই বিষয়টি বড় বড় বিনিয়োগকারীদের আশ্বাস দেয়। এর আগেও ডটকম কোম্পানির ধস, ২০০৭-০৯ সালের বিশ্ব আর্থিক সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারির সময় সোনার দাম হু হু করে বেড়েছিল।
কিন্তু এবারের খেলাটা একটু ভিন্ন। ২০২৪ সালের মার্চ থেকে সোনার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, অথচ বিশ্বে কোনো বড় অর্থনৈতিক মন্দা নেই। একই সময়ে আমেরিকার এসএন্ডপি ৫০০ শেয়ার সূচক ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে এবং ব্যাংক সুদের হারও বেশ চড়া।
তাহলে কি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বড় কোনো সংকটের ভয়ে সোনা কিনছেন? এই বছর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য শুল্ক এবং চীনের সঙ্গে তার সংঘাত বিশ্ব বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলার হুমকি তৈরি করেছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আমেরিকা তার ইতিহাসের দীর্ঘতম সরকারি শাটডাউন দেখেছে। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতের শেয়ার বাজারে ধস নামলে আসল অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে, এমন ভয়ও বাড়ছে।
কিন্তু এই থেমে থেমে আসা বিপদগুলোর সাথে সোনার প্রায় একটানা দাম বৃদ্ধিকে মেলানো কঠিন। যেমন, এই বছরের শুরুতেই সোনার বাজার গরম ছিল, যখন এআই নিয়ে এত ভয় শোনা যায়নি। ট্রাম্পের বাণিজ্য চুক্তি, চীনের সঙ্গে সমঝোতা বা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি—কোনোটিই সোনার দামে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমেরিকার শাটডাউন ১২ই নভেম্বর শেষ হওয়ার পর শেয়ারবাজার উঠানামা করেছে, কারণ ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাবে না বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু তখন সোনার দাম কমার বদলে আরও দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে।
দ্বিতীয় তত্ত্বটি হলো, এই সোনার দৌড়ের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা স্বল্পমেয়াদী বিপদ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত। এই 'অবমূল্যায়ন' তত্ত্ব বলছে, আমেরিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পাহাড়সমান সরকারি ঋণ ডলারের ওপর থেকে বিশ্বাস কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদী ডলারের সম্পদ বিক্রি করে নিরাপদ সোনা কিনছে।
কিন্তু এই গল্পের সমস্যা হলো, এর পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। যদি সত্যিই আমেরিকার সরকারি বন্ড ব্যাপকভাবে বিক্রি করা হতো, তাহলে ডলারের দাম পড়তো এবং দীর্ঘমেয়াদী সুদের হার বাড়তো। বাস্তবে, ডলারের দাম বেশ স্থিতিশীল আছে এবং ৩০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের সুদের হারও প্রায় একই রকম রয়েছে।
এই তত্ত্বের সমর্থকরা বলেন যে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কিনছে। কিন্তু সত্যিটা হলো, রিজার্ভে সোনার অংশ বাড়ার কারণ সোনার নিজের দাম বাড়ছে, ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও। পরিমাণে হিসাব করলে, উদীয়মান দেশগুলোর সোনা কেনা এখনও খুবই সামান্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি জানান, কেউই সোনার ওপর সবকিছু বাজি ধরতে চায় না, বিশেষ করে এমন একটি বুদবুদের পেছনে ছুটতে চায় না। তিনি বলেন: 'বেশিরভাগই এই সোনা অনেক বছর ধরে রাখতে চায়। তারা চিরকালের জন্য লোকসান দেখানোর ভয়ে থাকবে।' আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর তথ্যও বলছে, গত বছরের তুলনায় তাদের সোনা কেনার গতি কমেছে, বাড়েনি এবং এই কেনাকাটা মূলত হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংকই করছে।
এই পরিস্থিতিতে, সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে সম্ভাব্য চালক হিসেবে পূর্বানুমানকারীদেরই মনে করা হচ্ছে। আমেরিকার কমোডিটি ফিউচারস ট্রেডিং কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৩শে সেপ্টেম্বর হেজ ফান্ডগুলোর সোনা কেনার চুক্তি রেকর্ড দুই লাখে পৌঁছেছিল, যা ৬১৯ টন সোনার সমান। এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ড এর মাধ্যমেও প্রচুর সোনা কেনা হচ্ছিল।
সোসাইতে জেনারেল ব্যাংকের মাইকেল হেইগের মতে, গত মাসে ইটিএফ-এর কেনা কিছুটা কমেছিল এবং হেজ ফান্ডগুলো প্রায় ১০০ টন সোনা বিক্রি করেছিল। আর একারণেই মাসের শেষে সোনার দামে কিছুটা পতন দেখা যায়। এরপর থেকে ইটিএফ-এ আবার কেনা বেড়েছে (হেজ ফান্ডের নতুন তথ্য পাওয়া যায়নি)। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে সোনার দাম মূলত এই ধরনের অস্থায়ী তহবিলগুলোর ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে চলছে।
মনে হচ্ছে, যা শুরু হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সামান্য সোনা কেনার আগ্রহ দিয়ে, তা এখন পূর্বানুমানকারীদের 'গরম টাকার' এক বিশাল খেলায় পরিণত হয়েছে, যা দামকে শুধু উপরের দিকেই ঠেলছে। এটি 'শক্তিশালী হাত' বা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অশনিসংকেত।
বিনিয়োগের এই খেলা, যেখানে সবাই শুধু চলন্ত ট্রেনেই উঠতে চায় , তা কোনো না কোনো সময়ে থামবেই। আর এই খেলা যত লম্বা হবে, শেষে সবচেয়ে সাহসী খেলোয়াড়দের তত বেশি অর্থ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।
