অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩,২২২%, অর্থছাড় ৩৫.৭%
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি বড় আকারে উল্লম্ফন করেছে। আজ বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) প্রকাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩২২২ শতাংশ।
এসময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৯১০.৬৭ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছরের একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে থেকে প্রতিশ্রুতি এসেছিল মাত্র ২৭.৪১ মিলিয়ন ডলার।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, প্রথম প্রান্তিকে অর্থছাড় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫.৭ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় হয়েছে ১.১৪৭ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৮৪৬.১ মিলিয়ন ডলার।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়ের সঙ্গে ঋণ পরিশোধও বেড়েছে।
এসময়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১.২৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধে করেছে। গত অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ১.১২৬ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় বাড়লেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনিশ্চয়তার কারণে অর্থবছরের শেষার্ধে প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, 'গত বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, তখন একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। সরকারের পতন, নতুন সরকার আগমন, সহায়ক সরকারের আলোচনা—এসব কারণে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তাও কমে গিয়েছিল। অর্থাৎ গত বছর একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল, যার প্রভাবে নতুন প্রতিশ্রুতি ও বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশ আবার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে—এটা আন্তর্জাতিকভাবে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি বা সহায়তা বাড়তে শুরু করেছে। তবে ব্যবসা বা বিনিয়োগ সেই অনুপাতে বাড়েনি। কারণ এখনও অনেক বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। নানা ধরনের খুঁটিনাটি বিষয়ে একমত না হলে বড় সিদ্ধান্ত বা বিনিয়োগ আসবে না—এটিই স্বাভাবিক।'
তিনি আরও বলেন, 'আগামী কয়েক মাসের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি মূলত নির্ভর করবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। সামনে নির্বাচন, সেটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না, সব রাজনৈতিক দল সেই ফলাফল মেনে নেবে কি না—এসব প্রশ্ন এখনও অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তাই ব্যবসা ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। আন্তর্জাতিক মহল চায় একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক—যেখানে সব দল অংশ নেবে এবং ফলাফল মেনে নেবে। এটি এখনও বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যদি সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে একটি স্থিতিশীল, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে, নতুন কমিটমেন্ট ও বৈদেশিক সহায়তা বাড়বে, ব্যবসাও গতিশীল হবে।
'কিন্তু যদি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়—যেমন কোনো দল ফলাফল মানতে না চায়—তাহলে আবারও অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। তাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এগুলো বাস্তবায়ন হলে আগামী বছরে বিদেশি সহায়তা, নতুন প্রতিশ্রুতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছুই ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে এবং আমরা সেই সহায়তা ও সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হব।'
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও সিইও মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'গত অর্থবছরের এই সময়টা ছিল রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়, যখন সরকারের রদবদল ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে উন্নয়ন অংশীদারদের পক্ষ থেকে নতুন প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্প অনুমোদনের প্রবণতা কমে গিয়েছিল। এ বছর সেই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সরকার এখন আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক ঋণ, ও উন্নয়ন ব্যয়ের বিষয়ে তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থানে এসেছে। অর্থাৎ সরকারের রাজস্ব নীতি ও বৈদেশিক সহায়তা ব্যবস্থাপনায় স্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।'
তবে এখনও অনেক উন্নয়ন অংশীদার নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচন শেষে যখন একটি স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তখন নতুন নীতিনির্ধারক দলের সঙ্গে তারা আলোচনা করে নতুন প্রকল্প অনুমোদন ও কমিটমেন্ট বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতির ও অর্থছাড়ের সঙ্গে ঋণ পরিশোধও বেড়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধ বেড়েছ ১৩.৬ শতাংশ।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১.২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধে করেছে। গত অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ১.১২৬ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের প্রথম তিন মানে আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮১৬.৯ মিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৬৮৫.৫ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের বিভিন্ন ঋণের সুদ প্রেমেন্ট করা হয়েছে ৪৬৩ মিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৪১মিলিয়ন ডলার।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ বিগত সময়ে অনেক বড় বড় ঋণ নিয়েছে। এর অনেক প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এটা আগামীতে আরও বেড়ে যাবে।
এদিকে ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে জুলাই -সেপ্টেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি ৪৮১ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে এডিবির কাছ থেকে । বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১২.৪৪ মিলিয়ন ডলারের। এছাড়া অনান্য উন্নয়ন সহযোগীরা ৪১৬.৫২ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সবেচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি সর্বোচ্চ ৩২২.৬৩ মিলিয়ন ডলার অর্থছাড় করেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১৫.৩৯ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে রাশিয়া। এছাড়া এডিবি ১৮৭.৭২ মিলিয়ন ডলার, ভারত ৬৩মিলিয়ন ডলার ও জাপান ৪০.৬৭ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে।
