৫ আগস্টের আগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

শেখ হাসিনার সরকারের আমলে নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিকৃত ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা পুনর্গঠনের জন্য মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সার্কুলার অনুযায়ী, এ সুবিধা পাওয়া গ্রাহক সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড পাবেন। তবে ডাউনপেমেন্ট নগদে পরিশোধ করতে হবে; আগের কিস্তি পরিশোধ ডাউনপেমেন্ট হিসেবে ধরা যাবে না।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে। এ সুবিধা পেতে হলে আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে আবেদন করতে হবে। তবে জাল-জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণের ক্ষেত্রে এ সুযোগ প্রযোজ্য হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের মাস্টার সার্কুলারে বলা ছিল— একজন গ্রাহকের সর্বোচ্চ ৮ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল এবং সর্বনিম্ন ২.৫ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিতে হবে। নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে, যেসব গ্রাহক তিন বা ততোধিকবার ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিতে হবে। ঋণ আদায় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে করতে হবে।
এর আগে, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পুনর্গঠনে নীতি সহায়তা কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই কমিটির আওতায় চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান পুনঃতফসিল সুবিধা পায়।
এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং কিছু ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এ সুবিধা নেয়। এমনকি একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানকে ১২ বছরের মেয়াদে সুদমুক্ত পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "নীতি সহায়তা কমিটির আওতায় ইতোমধ্যে ১,২০০-এর বেশি গ্রাহক আবেদন করেছে। যারা সুবিধা পেয়েছে তাদের দেখাদেখি আরও অনেকে আবেদন করার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে ডিল করা সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকগুলোর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কমিটির আওতায় যারা ইতোমধ্যে সুবিধা পেয়েছেন তাদের নতুন করে যাচাই করা হবে না।"
সার্কুলারে আরও বলা হয়, বিশেষ পুনঃতফসিল সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণসমূহকে (এসএমএ) শ্রেণিকৃত করতে হবে এবং তার বিপরীতে যথাযথ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
যা বলছেন ব্যাংকাররা
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "এটা বেশ বড় একটি সুবিধা দেওয়া হলো। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হতে পারে। তবে এ ঋণের টাকা ফেরত আসবে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "দুই বছর পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড থাকবে। এই সময়ে কী ঘটবে তা জানা নেই। দুই বছর পর গ্রাহক টাকা পরিশোধ না করলে তখন কী হবে? গ্রাহকদের সত্যিই টাকা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।"
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন টিবিএসকে বলেন, "বাস্তবে অনেক কিছুই ঘটছে। অনেক ব্যবসায়ী প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আবার রাজনৈতিক কারণে অনেকেই ব্যবসা চালাতে পারেননি। এসব কারখানা সচল করতে হবে। তাদের সুযোগ দেওয়া হলে ক্ষতি নেই। ব্যবসা বন্ধ হলে মানুষের কর্মসংস্থানও বন্ধ হয়।"
তিনি বলেন, "তাই এ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। সে হিসেবে আমি এটিকে ইতিবাচক মনে করি।"
নীতি সহায়তা প্রাপ্তির যোগ্যতা
ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলো এ সুবিধা পাবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বা অব্যবসায়িক কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান ইউটিলিটি সংযোগ পায়নি, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ও বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এছাড়া, যারা এর আগে কোনো ধরনের পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন বা নীতি সহায়তা পায়নি, তাদের আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
আবেদন প্রক্রিয়া
ঋণগ্রহীতাকে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে লিখিত আবেদন জমা দিতে হবে এবং আবেদন প্রধান ব্যাংকের কাছে জমা দিতে হবে।
আবেদনের সময় নির্ধারিত ডাউনপেমেন্ট বা কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শ্রেণিকৃত ঋণগ্রহীতারা এ সুবিধার আওতায় পুনঃতফসিলের আবেদন করতে পারবেন।
তবে যেসব ঋণের বকেয়া ৩০০ কোটি টাকার বেশি, সেগুলো কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের মাধ্যমে পুনঃতফসিল করা যাবে। আবেদন অনুমোদনের আগে ব্যাংক ঋণগ্রহীতার আর্থিক সক্ষমতা, ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি যাচাই করবে।
আগে যারা ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করেছেন, তারা এ নতুন সুবিধার জন্য যোগ্য হবেন না। নির্ধারিত সময়ে আবেদন জমা না দিলে বা শর্ত পূরণ না হলে আবেদন বাতিল হবে। একইভাবে, ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া পুনঃতফসিল করা যাবে না।