জেলে থাকা চেয়ারম্যানের সইয়ে নাসা গ্রুপকে টিকিয়ে রাখতে ঋণচুক্তিতে মধ্যস্থতা করবে সরকার

ঋণগ্রস্ত নাসা গ্রুপকে পুনরায় সচল করতে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকার নতুন ঋণ প্যাকেজ নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এই অর্থায়নে যুক্ত হবে। এর লক্ষ্য হলো বন্ধ থাকা কারখানাগুলো চালু করা, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন মেটানো এবং প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিকের চাকরি রক্ষা করা।
তবে পুরো প্রক্রিয়া নির্ভর করছে এক নজিরবিহীন শর্ত—জেলগেইটে গ্রুপ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ এবং তার সই নেওয়ার ওপর। গত বছরের অক্টোবর থেকেই কারাগারে রয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার।
চেয়ারম্যান জেলে, কারখানা সংকটে
২০২৪ সালের ২ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংশ্লিষ্ট এক মামলায় তাকে আটক করা হয়। তবে কারাগারে থাকলেও প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে এখনো তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার অবস্থায় আছেন।
গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই নাসা গ্রুপ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সব কারখানা বন্ধ। ব্যাংক ঋণের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি; ইউটিলিটি বিল বকেয়া হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা, শ্রমিকদের জুলাই মাসের বেতন বাকি ১১ কোটি টাকা।
কারখানা পুনরায় চালু করতে নাসা গ্রুপ ব্যাংকগুলোর কাছে এলসি সুবিধা ও নতুন ঋণ চাইছে। তবে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ থাকায় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় নাসা গ্রুপ ইতোমধ্যে সরকারের সহায়তার জন্যও আবেদন করেছে।
কারাফটকে নজিরবিহীন বৈঠক
গত ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়—ঋণ ছাড়ের আগে ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরা কারাফটকে গিয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সেখানে তিনি তার মর্টগেজবিহীন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির দলিলে সই করবেন, যা নাসা গ্রুপের বিদ্যমান ঋণের জামানত হিসেবে ধরা হবে।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, স্থাবর সম্পদ বিক্রি সময়সাপেক্ষ বিধায় ঋণের বিপরীতে নতুন জামানত গ্রহণের মাধ্যমে ঋণের সিকিউরিটিজ কভারেজ নিশ্চিত করতে বলেছে ব্যাংকগুলো। নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ নাসা গ্রুপ এতে রাজী থাকলে গ্রুপভুক্ত কারখানাগুলো চালু করতে নতুন করে ১৬৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালবক মো. আশরাফুল আলমের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই সভায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তা, নাসা গ্রুপের ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং নাসা গ্রুপের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যানর জেলগেইটে মিটিং আয়োজনের পাশাপাশি সম্পত্তি বিক্রির দলিলে স্বাক্ষর নেওয়ার সুযোগ দিতে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে নাসা গ্রুপ।
এবিষয়ে জানতে চাইলে নাসা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম ২ সেপ্টেম্বর টিবিএসকে বলেন, "এলসি খোলার জন্য চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের দরকার হয় না। তবে কোনো ঋণ নিতে হলে ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর দরকার হয়। আর চেয়ারম্যানের সাথে ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ করার বিষয়টিও প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে। এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা আছে। আমরা আশা করি, প্রয়োজন হলে সরকার নিশ্চয় সহযোগিতা করবে।"
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম টিবিএসকে বলেন, কারাগারে থাকা অবস্থায় দলিলে বা মর্টগেজের নথিতে স্বাক্ষর আইনগতভাবে বৈধ নয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে সই থাকলে তা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে।
সম্প্রতি আদালতে দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলাম বলেছেন, তাকে জামিন দেওয়া হলে ব্যাংকের সব টাকা পরিশোধ করে দেবেন।
৮ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ
৩০ জুন পর্যন্ত ২২টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৮ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে নাসা গ্রুপের। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংকে ১ হাজার ২৬৬.৯২ কোটি টাকা। এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে নাসা ও এস আলম গ্রুপের ভাইস-ভার্সা ঋণ রয়েছে।
নাসা গ্রুপের কারখানাগুলো চালু করতে গত ৪ জুন থেকে শ্রম উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, বিজিএমইএ ও ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক হয়।
সভায় নাসা গ্রুপের কর্মকর্তারা বলেছেন, আইনগত জটিলতার কারণে মালিকপক্ষ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও—ব্যবস্থাপনা কমিটি কারখানাগুলো চালু রাখতে আগ্রহী। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে খেলাপি গ্রাহক হিসেবে সরাসরি এলসি খুলতে না পারায়, সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে গত জুন পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। তবে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধের মতো টাকা নেই।
শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ ও কারখানা চালু রাখতে ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক হতে দুই বছরের জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার সুবিধা এবং ১৬৫ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণ সুবিধা চেয়ে আবেদন করেছে নাসা গ্রুপ।
সভায় সিটি ব্যাংকের প্রতিনিধি জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু ব্যবসায়িক আয় দিয়ে ঋণের দায় পরিশোধ করা নাসা গ্রুপের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মালিকপক্ষের মর্টগেজবিহীন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হলে গ্রুপটির পুনরুদ্ধার সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পরিচালক বলেন, শুধু নীতি সহায়তা দিয়ে নাসার বিপুল ঋণ পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। কিছু মর্টগেজবিহীন সম্পত্তি বিক্রি করে ডাউন পেমেন্ট দিলে পুনঃতফসিল করা যেতে পারে।
সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, কারখানা চালু রাখতে নাসা গ্রুপ ব্যাংকগুলোর কাছে আবেদন করবে। ব্যাংকগুলো সেই আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর সেগুলো আবার বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে যাবে। তারপর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা কার্যকর করবে।
নাসা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকের পর নাসা গ্রুপ থেকে ৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে এলসিসহ অন্যান্য ব্যাংকিং সহযোগিতার জন্য আবেদন করা হয়েছে।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক নাসার আবেদন অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। "আশা করা যায় দ্রুত অন্যান্য ব্যাংকও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে চিঠি পাঠাবে। আমরা আশা করছি, এ মাসের মধ্যেই এলসি খোলা যাবে।"
জুলাইয়ের বেতন বাকি ১১ কোটি টাকা, শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা
নাসা গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, বকেয়া ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করে কারখানা সচল রাখতে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে গত ১ সেপ্টেম্বর আবেদন করেছে নাসা গ্রুপ।
গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার কারাবন্দী অবস্থায় আছেন এবং চেয়ারম্যানের পরিবারে বাকি সদস্যরা বিদেশে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় শ্রমিক ও শিল্পের স্বার্থরক্ষায় গ্রুপের ম্যানেজমেন্ট কমিটি কারখানাগুলো সচল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকে ব্যাংকগুলো নাসা গ্রুপের সব ধরনের এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে সরাসরি কার্যাদেশ নেওয়া যাচ্ছে না। পূর্বের নেওয়া অর্ডার ও সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কিছু কাজ করলেও—বর্তমানে কোন কাজ নেই। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা সংগ্রহের মাধ্যমে এতদিন শ্রমিকদের বেতন দিয়ে আসছি, যা এখন আর কোনমতেই সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ইউটিলিটি বিল বকেয়া হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা, শ্রমিকদের জুলাইয়ের বেতন বাকি ১১ কোটি টাকা। বেতন দেওয়ার কোন ব্যবস্থাই আমাদের হাতে নেই।
শতভাগ রপ্তানিমুখী নাসা গ্রুপের গার্মেন্টস, ওয়াশিং, এমব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, টেক্সটাইল, ফ্লিস মিল ও ডেনিম মিল রয়েছে। নাসা গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, গ্রুপের অধীন ৩৪টি কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।