৩০০ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা: ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

দেশের বৃহত্তম কয়েকটি করপোরেট ঋণখেলাপিসহ প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ সুবিধার আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প ডাউন পেমেন্টে ও সর্বোচ্চ তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডে ১৫ বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেতে পারে।
এই পদক্ষেপকে ঘিরে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, এ সুবিধায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেলেও এতে তাদের ক্যাশ-ম্যানেজমেন্টে উন্নতি হওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
অবশ্য অনেকে এ-ও বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সুদহার বৃদ্ধিসহ অনেক কারণই আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার পেছনে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত।
তবে এর আগে এমন সুযোগ দেওয়ার পরও ঋণ আদায় না হওয়ার বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখতে বলছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, বিশেষজ্ঞ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, 'প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই বিগত ১৬-১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারেনি। ফলে তাদের ঋণগুলোও খেলাপি হয়ে পড়েছে।'
আরিফ আরও বলেন, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা, ডাউনপেমেন্টের পরিমাণ ও গ্রেস পিরিয়ড ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতা দুপক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। 'এতে একদিকে যেমন ব্যাংকের প্রভিশনিং রিকোয়ারমেন্ট কমবে, অন্যদিকে গ্রাহকও উপকৃত হবে।'
অতীতের ব্যর্থতা ও তদারকি নিয়ে উদ্বেগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অভ কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) ব্যাংকিং কমিশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, অতীতের মতো একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে তিনি কোনো ইতিবাচক ফলাফলের আশা করছেন না।
তিনি বলেন, 'পুনঃতফসিলকৃত ঋণের কার্যকারিতা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কি কোনো ফরেনসিক করেছে? এটি নিঃসন্দেহে ব্যর্থ মডেল।'
আলী পরামর্শ দেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল জামানত বাড়িয়ে ও ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আরও বেশি অবদান নিশ্চিত করে নতুন একটি মডেল তৈরি করা।
তিনি মনে করেন, ঋণগ্রহীতার দায়মুক্ত সমস্ত ব্যবসা ও ব্যক্তিগত সম্পদকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত এবং সফলভাবে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে 'সীমিত দায়'-এর ধারণাটি বাধা হওয়া উচিত নয়।
আলী আরও বলেন, 'আশা করি, বাংলাদেশ ব্যাংক এসব পুনঃতফসিলকৃত ঋণে ওপর সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করবে। আমরা কোনোভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।'
অডিট প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই অনুমতি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক এখন ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেবে ঋণ পুনঃতফসিল করবে কি না।
ঋণ পুনঃতফসিল করা হলে ব্যাংকগুলোর নগদ প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'ঋণগুলোর একটা বড় অংশই আদায় না হওয়ার পরও আগে যেখানে ব্যাংকগুলো টাকা পেতে ৩ বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করেছিল, এখন এই ঋণগুলো পুনঃতফসিল করা হলে হয়তো ১০ বছর সময় লেগে যাবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপের মতোই কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর বলেন, 'আগের সরকার নির্দিষ্ট কিছু গ্রুপকে সুবিধা দেওয়ার জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সার্কুলার জারি করত। সে কারণে অন্য গ্রুপগুলোও হয়তো কিছু সুবিধা পেত। এবার তা করা হয়নি। এবার যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমতি দেওয়ার চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'
সতর্কতা ও সৎ ব্যবহার নিশ্চিতের আহ্বান অর্থনীতিবিদদের
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, কিছু ছাড় দিলে ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা বাড়বে, এই ভরসা হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক অডিট প্রতিবেদনগুলো থেকে পেয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমার মনে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর অবস্থানে যাওয়ার আগে ঋণ পরিশোধে খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত হওয়ার একটা সুযোগ দিতে চাচ্ছে।'
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী সতর্ক করে বলেন, এ ধরনের সুবিধার ফলে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা গেলেও বাস্তবে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
'অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ঋণ পুনঃতফসিল করা প্রতিষ্ঠান নানান সুবিধা নিলেও ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করেন না,' বলেন তিনি।
মুজেরী জোর দিয়ে বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের একটা সৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে। ঢালাওভাবে সব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনঃতফসিল করতে দেওয়া উচিত হবে না। 'ব্যাংকগুলো যে ক্ষমতার মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিল করবে, সেটির সৎ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এসব সুবিধার যেন আর কোনো অপব্যবহার না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।'