বাজেটে জনগণকে তুষ্ট করার যত প্রস্তাব: প্রকৃত সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকারের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জনগণকে তুষ্ট করার বেশ কিছু উদ্যোগ রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে। তবে এসব উদ্যোগ থেকে জনগণ শেষ পর্যন্তু বাস্তবিক কতটুকু সুফল পাবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তার বাজেট বক্তব্যে আগামী অর্থবছরে সারা দেশের ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই এমপিওভুক্তির কাজ চলমান। এজন্য তিনি বরাদ্দও প্রস্তাব করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা থাকলেও অর্থ উপদেষ্টা আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, '২০১৫ সালের পর থেকে কোনো বেতন কাঠামো না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করছি।'
যদিও সরকারের এ সিদ্ধান্তে মূল্যস্ফীতি ও বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
স্বাস্থ্যসেবা সহজ করতে ২৩২টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু এবং 'স্বাস্থ্য বাতায়ন' নামে হেলথ কল সেন্টারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পরামর্শসেবা চালুর কথা বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা। বলেছেন, মাস্টার্স ও এফসিপিএস-এর বেসরকারি শিক্ষার্থীদের মাসিক পারিতোষিক ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা হবে এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কমিউনিটি শিক্ষা ভাতা ও নার্সিং শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়া চিকিৎসা শিক্ষায় মৌলিক বিষয়ের শিক্ষকদের মাসিক প্রণোদনা ভাতা মূল বেতনের ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে যা আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর হবে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আগামী অর্থবছরে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে অতিরিক্ত ৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। যদিও স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে অনেক বছর ধরে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারি বরাদ্দ ব্যয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা কেয়ারগিভারদের বিদেশে কাজের উপযুক্ত করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও বলেছেন। পাশাপাশি নার্সিং শিক্ষায় পিএইচডি কোর্স চালু এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য একটি নার্স শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয় সরকার বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন।
এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের শূন্য পদ পূরণে চিকিৎসক, সেবিকা, টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট ও স্বাস্থ্য সহকারীদের নিয়োগ ত্বরান্বিত করা এবং বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা।
তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হবে। তারুণ্যের উৎসব উদযাপনে ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে ২.২০ লাখ মানুষকে বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার চলমান ধারা অব্যাহত রাখার জন্য রপ্তানিমুখী এবং ক্ষুদ্র ও মধ্য পর্যায়ের শিল্পগুলোকে বৈশ্বিক হাই-ভ্যালু চেইনের সাথে সংযুক্ত করার এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কয়েকটি কর্মসূচিতে ভাতা ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বাড়বে।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় ৪০০টি ইলেকট্রিক বাস যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এই বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার নিয়ে দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। নিরাপদ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হিসেবে রেল পরিবহণ বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও জানিয়েছেন উপদেষ্টা।
অবকাঠামো পরিকল্পনার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ভবনসহ আইসিটি অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব অবকাঠামো আইসিটি শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও স্টার্টআপ ইনকিউবেশন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
এসব উদ্যোগের বিষয়ে সিপিডির ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, উদ্যোগগুলো অবশ্যই ভালো। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন কতটা স্বচ্ছতা ও নায্যতার সঙ্গে হবে, তার ওপর নির্ভর করবে উদ্যোগের ফল মানুষ কতটা পাবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে সামাজিক নায্যতা নিশ্চিত করতে সরকারকে অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতের মানুষদের করের চাপ কমে। 'সরকারি সেবা কম খরচে ও বিনামূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতের মানুষের ওপর ব্যয়ের চাপ কম হয়। বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, এমন কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করতে হবে।'