আমদানি কম, আস্থা নেই, প্রবৃদ্ধি শ্লথ: বাংলাদেশ কি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ছে?

বাংলাদেশের বার্ষিক আমদানি যদি ১০ বিলিয়ন ডলার কমে যায়, তাহলে এর প্রভাব কেবল সংখ্যাগত ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না—বরং তা বহুগুণ বেশি নেতিবাচক অভিঘাত তৈরি করতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই পতনের প্রকৃত ক্ষতি দ্বিগুণ বা তারও বেশি হতে পারে, কারণ এটি দেশের অন্তর্নিহিত ও গভীর অর্থনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশের আমদানি কেবল ভোগ্যপণ্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর একটি বড় অংশই শিল্প খাতে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের মতো উৎপাদনের অত্যাবশ্যক উপকরণ। এসব উপকরণ দেশের উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। একটি আমদানিকৃত তুলার রোল, রঞ্জক ও রাসায়নিকের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশি হাতে তৈরি হয় একেকটি পোশাক, যা পরে বহুগুণ দামে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হয়। একইভাবে, একটি আমদানিকৃত যন্ত্রও একটি কারখানাকে সচল রাখতে পারে, হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং রপ্তানি খাতকে সচল রাখে। ফলে, এসব উপকরণ শুধু আমদানিকৃত সামগ্রী নয়—এগুলোই দেশের মূল্য সৃষ্টির ইঞ্জিন।
আমদানি হ্রাসের সুদূরপ্রসারী প্রভাব
এই প্রেক্ষাপটে, আমদানিতে উল্লেখযোগ্য হ্রাস মানে হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ার মন্থরতা, রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস, এবং হাজার হাজার কর্মসংস্থান ও পরিবারের আয়ের অনিশ্চয়তা।
'আমদানি ১০ বিলিয়ন ডলার কমে গেলে তা অর্থনীতিতে ২০ বিলিয়ন ডলারের সংকোচন ঘটাতে পারে,' বলেন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে. চৌধুরী। তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'অর্থায়ন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন পর্যন্ত—সরবরাহ শৃঙ্খলার প্রতিটি স্তরের সঙ্গে মানুষের জীবিকা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম জড়িত।'
গত তিন অর্থবছরে আমদানির ধারাবাহিক হ্রাস এই সংকটের গভীরতা স্পষ্ট করে তুলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে আমদানির পরিমাণ ছিল ৮২ বিলিয়ন ডলারের বেশি, তা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় ৭১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে তা ৬৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আপাতদৃষ্টিতে এই পতন বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষার ইঙ্গিত দিতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা আরও উদ্বেগজনক। এই দীর্ঘস্থায়ী পতন অভ্যন্তরীণ চাহিদার দুর্বলতা, বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা, শিল্প খাতের গতি হ্রাস এবং সবচেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে, নতুন শ্রমশক্তির জন্য কর্মসংস্থানের অচলাবস্থার প্রতিফলন।
আমদানি-নির্ভর অর্থনীতির জন্য সতর্কসংকেত
একটি আমদানি-নির্ভর অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এই প্রবণতা অত্যন্ত গুরুতর সতর্কবার্তা। এর প্রভাব ইতোমধ্যেই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৯৭ শতাংশে—যা ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির পর সর্বনিম্ন।
এ প্রভাব বিভিন্ন খাতে এখন দৃশ্যমান। সামুদ্রিক ও অগ্নিবীমার মতো খাত, যা সরাসরি আমদানি ও নতুন শিল্প বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত, সেখানেও সংকট দেখা দিয়েছে। 'নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই, নতুন কোনো ব্যবসাও আসছে না। আমরা কেবল পুরোনো পলিসি নবায়নের ওপর নির্ভর করে টিকে আছি,' বলেন একটি শীর্ষস্থানীয় বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
জার্মান বহুজাতিক রাসায়নিক কোম্পানি বিএএসএফ-এর সহযোগী বিএএসএফ বাংলাদেশ লিমিটেড, যারা বাংলাদেশে ডেনিম, ডাইং, প্লাস্টিক, প্যাকেজিং ও ওষুধ শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহ করে, তারাও বাজারে দুর্বল চাহিদার কথা জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাজ্জাদুল হাসান বলেন, 'সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যবসার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও, মুনাফা এবং পণ্যের দাম—উভয়ই কমে গেছে।'
বেসরকারি খাতে স্থবিরতা
এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির ধীরগতির মাধ্যমে। যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এই অর্থনৈতিক অচলাবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। গত তিন বছর ধরে এটি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে, ফলে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং কর্পোরেট বিক্রয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। 'আমাদের বিক্রয় অন্তত ১০ শতাংশ কমে গেছে। দাম যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, একজন ভোক্তা আর কি-ই-বা করতে পারেন? তারা বাধ্য হয়ে খরচ কমিয়ে দেন,' বলেন দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য আমদানিকারক ও বিক্রেতা মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্রমবর্ধমান ব্যয় সংকটে পড়ছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। বিএএসএফ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান বলেন, 'সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যার ফলে তহবিল সংগ্রহের খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ে এবং মুনাফার পরিমাণ সংকুচিত হয়ে এসেছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে বড় শিল্প খাতের জন্য ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২.৪৩ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য তা ছিল ১২.৪৮ শতাংশ। ঠিক এক বছর আগেও এই হার ছিল যথাক্রমে ১০.১৫ শতাংশ ও ১০.৩১ শতাংশ। তুলনার জন্য, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গড় ঋণের হার ছিল ৮ শতাংশের নিচে। ফলে, এই বৃদ্ধিকে একটি দ্রুত এবং উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হিসেবেই ধরা যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলো—যেমন মুডি'স, ফিচ এবং এসঅ্যান্ডপি—দেশের সার্বিক অর্থনীতি এবং স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দেওয়ার পর বৈদেশিক ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) নিশ্চিতকরণে অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করেছে। বর্তমানে এই চার্জ বার্ষিক ৩.৫ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, কিছু সবল ব্যাংক নিজেদের ঋণসীমা উন্নত করতে পারলেও, এলসি নিশ্চিতকরণে খরচ এখনও উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে।
'ব্যবসায়িক আস্থা একেবারে তলানিতে'
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ সংকটকে ঘিরে শুধু মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যয় বৃদ্ধির দিকেই ইঙ্গিত করেননি—তিনি এর বাইরেও আরও গভীরতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার ভাষায়, 'ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশকে আরও প্রতিকূল করে তুলেছে।' তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'বর্তমানে ব্যবসায়িক আস্থা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে।' তার অভিমত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাস সরবরাহ সংকটে ভুগছে, এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বন্দর ও সচিবালয়ের কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তার মতে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি জাতীয় নির্বাচন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ পোশাক রপ্তানিকারকের অন্যতম প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর দেশের রপ্তানির ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যা রপ্তানি কার্যক্রমকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। তবে সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তিনি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন—জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা গেলে শিল্পের অগ্রগতি অব্যাহত রাখা সম্ভব। তার মতে, 'আমাদের শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।' তিনি আরও জানান, সম্প্রতি টেক্সটাইল মিল মালিকরা প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন, কারণ ২০২৩ সালে গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ এবং চলতি বছর আরও ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির পরও তারা গ্যাস ঘাটতির কারণে কার্যত 'মৃত্যুদণ্ড' পাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য ২০২৫-২৬ বাজেটে?
এমন এক জটিল ও চাপপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে, যার প্রধান লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. কেএএস মুর্শিদ মনে করেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত অর্থনৈতিক ভিত্তিকে স্থিতিশীল করা। যদিও তিনি ব্যাংকিং খাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছেন, তবে পাশাপাশি আরও কাঠামোগত সংস্কারের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন।
মুর্শিদ বলেন, 'আমরা এমন এক বাস্তবতায় অবস্থান করছি, যেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমাদের লড়তে হচ্ছে জ্বালানি ঘাটতি, শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংক ঋণের সীমিত প্রবেশাধিকার এবং এলসি খোলার জটিলতার মতো মৌলিক বাধাগুলোর সঙ্গে।' তার মতে, এ অবস্থায় সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত—খাদ্য উৎপাদনের কার্যকর তদারকির পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতিকে একটি সুস্থ ও টেকসই পথে ফিরিয়ে আনা।
তার এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তার মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, 'মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ—বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতে।'
ড. ফাহমিদা আরও বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বরং সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'