এনবিআরকে বিলুপ্ত করল সরকার; রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনায় দুটি পৃথক বিভাগ গঠন

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন ১৯২৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ভূমি কর আদায়ের জন্য একটি রাজস্ব বোর্ড গঠন করে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে গেছে ৭৮ বছর আগে। তারপরে এই অঞ্চল বিভক্ত হয়ে তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়—ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ—যাদের অর্থনীতি এখন অনেক বেশি বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময়।
এরপর থেকে বাংলাদেশে কর প্রশাসন মূলত সেই ঔপনিবেশিক যুগের কাঠামোর ওপরই নির্ভর করে পরিচালিত হয়ে আসছে।
এবার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপে ১০১ বছরের পুরোনো সেই কাঠামো ভেঙে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত সোমবার রাতে জারি করা একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে দুটি আলাদা শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে—একটি নীতিনির্ধারণের জন্য, অপরটি বাস্তবায়নের জন্য।
এই বিভাজনের লক্ষ্য হলো কর প্রশাসনকে আধুনিকায়ন করা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমানো এবং করদাতাদের সেবার মান উন্নত করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিভাজন করদাতাদের ক্ষমতায়ন করবে, সেবা প্রদানব্যবস্থা উন্নত করবে এবং কর কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হলে প্রতিকার পাওয়ার একটি স্পষ্ট পথ তৈরি করবে। কর নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কাজ আলাদা করে— বহু পুরনো কাঠামোগত অসঙ্গতি দূর করার লক্ষ্যেই এই সংস্কার করা হয়েছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, "এই সংস্কার নিয়ে বহু বছর ধরেই আলোচনা চলছিল, কিন্তু রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অনাগ্রহের কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে ইচ্ছাশক্তি দেখিয়েছে।"
সরকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নবগঠিত রাজস্ব নীতি বিভাগ— কর আইন প্রণয়ন, করের হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। অপরদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ— বাস্তবায়ন, নিরীক্ষা ও কর পরিপালন সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি করবে।
সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, "প্রতিটি বিভাগ তার নিজস্ব কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারবে, বিশেষায়িত জ্ঞান বাড়বে, স্বার্থের সংঘাত কমবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সততা উন্নত হবে।"
"এই সংস্কার করের আওতা বাড়াবে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং উপযুক্ত পদে দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহকে আরও শক্তিশালী করবে। স্বচ্ছ, পূর্বানুমেয় নীতি এবং পেশাদার কর প্রশাসন বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে এবং বেসরকারি খাতের অভিযোগ হ্রাস পাবে।" বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই বিভাজন নিশ্চিত করবে যে, কর নির্ধারণকারী কর্মকর্তারা আর কর সংগ্রহের দায়িত্বে নেই, ফলে অপব্যবহারের সুযোগ কমবে।
বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রাজস্ব নীতি বিভাগের প্রধান হবেন 'উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন' সরকারি কর্মকর্তা। এছাড়া এই বিভাগের বিভিন্ন পদগুলো পাবেন আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), কাস্টমস, ইকোনমিক্স, ব্যবসায় প্রশাসন, পরিসংখ্যান, নিরীক্ষা এবং আইন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাগণ।
এই বিভাগকে সহায়তার জন্য একটি অধ্যাদেশে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, নিরীক্ষক, ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর প্রতিনিধি, ট্যারিফ কমিশনের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবেন। এই বিভাগের আওতায় আসবে এনবিআরের আওতাধীন আপিলাত ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান হবেন রাজস্ব আহরণ বিষয়ে অভিজ্ঞ কোনো জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা। এই বিভাগ মূলত মাঠ পর্যায়ের রাজস্ব আহরণ, এনফোর্সমেন্ট, অটোমেশন সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করবে।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির একটি আদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রশাসনিকভাবে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)-এর অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল।
তবে নতুন দুটি বিভাগের গঠনের ফলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করা হবে। আইআরডির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্ব নীতি বিভাগে এবং বর্তমান এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যাস্ত করা হবে।
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ প্রকাশ
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, 'আমাদের বহুদিনের দাবি ছিল, রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা হোক, যাতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমে। সেই কাজটি হয়েছে। কিন্তু এতে ব্যবসায়ীদের মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয় না।"
অন্যদিকে সংস্কার কমিটির সুপারিশ কী ছিল, তা-ও আমরা জানি না। 'আবার অধ্যাদেশটি অতি গোপনে, গভীর রাতে জারি করা হয়েছে – এ কারণে আমাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য ঠিক থাকলেও— আলোচ্য কারণে সন্দেহ তৈরি হয়।'
তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে কি এটি করা হয়েছে? নতুন সরকার এসে এই সেপারেশন মানবে?'
সিপিডির গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খানের কণ্ঠেও একই আশঙ্কার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, "দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এই সংস্কার চেয়ে আসছিলাম, যা সরকার করেছে। কিন্তু এর ফলাফল নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে – কারণ গোপনীয়তার সাথে গভীর রাতে প্রকাশ করা হয়েছে।"
তিনি বলছেন, রাজস্ব সংস্কার কমিটির সুপারিশ কতটুকু নেওয়া হয়েছে— সে বিষয়েও কোন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বর্তমান রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে। সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এটি বাস্তবায়ন করা না গেলে এর বাস্তবায়ন টেকসই করা কঠিন হবে।
কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা এনবিআরের দুই ক্যাডারের
এনবিআরের কিছু কর্মকর্তারা বলছেন, এই অধ্যাদেশ যেভাবে করা হয়েছে, তার মাধ্যমে দুটি বিভাগের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রশাসন ক্যাডারের হাতে চলে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছে। এর ফলে এনবিআরের দুই ক্যাডারের কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে যাবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কাস্টমস ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'সংস্কার কমিটির সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে যেভাবে এটি পাশ করা হয়েছে, তাতে এনবিআরে এডমিন ক্যাডারের আধিপত্য বাড়বে।'
সরকারের অন্যান্য সব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও, কেবল রাজস্ব সংস্কার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করায় – বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে।
এদিকে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব খাতকে— দুটি পৃথক বিভাগে ভাগ করার প্রতিবাদে গতকাল এনবিআর সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে কলম-বিরতি পালন করার ঘোষণা দেন এনবিআরের কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডাররা। তাঁরা রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি প্রকাশের দাবিও জানান।
কমিশনের সদস্য মো. আমিনুর রহমান টিবিএসকে জানান, তাদের সুপারিশে "পলিসি ও ম্যানেজমেন্ট – দুটি বিভাগেরই প্রধান হবেন এনবিআর ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তা। আর বাস্তবায়নে যারা কাজ করবেন তারা সবাই এনবিআরের দুই ক্যাডারের কর্মকর্তারা হবেন – এমন প্রস্তাব ছিল।"
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়গুলো খুবই টেকনিক্যাল, এবং এতে স্পেশালাইজড জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া এই কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে করা কঠিন। কিন্তু অধ্যাদেশ দেখে মনে হয়েছে, ওই সুপারিশটি বাস্তবে আসেনি।"
বাংলাদেশের সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, কোনো 'ডিভিশন' এনফোর্সমেন্ট এর কাজ করতে পারে না। এটি করতে পারে 'এজেন্সি'। কিন্তু এখানে ডিভিশনের কথা বলা আছে, এজেন্সির কথা নেই।"
এনিয়ে মতভেদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, এ বিষয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, এই সংস্কার জাতীয় রাজস্ব আদায়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না, বরং আরও দক্ষতা বাড়াবে। পাশাপাশি এনবিআরের কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ারেও এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
সংশোধনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে অধ্যাদেশটিকে বাস্তবায়নের আগে সংশোধন করা উচিত হবে। আমিনুর রহমান বলেন, 'সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সরকার চাইলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামতের ভিত্তিতে এটিকে সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে পারে।'
একই কথা বলেছেন তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, 'বিস্তৃত ঐকমত্য ছাড়া এই সংস্কারের স্থায়ী বাস্তবায়ন কঠিন হবে।'
গত ৪ মে এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, যেহেতু এটি একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে হবে, তাই বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, "সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একমত হতে হবে। আমাদের পার্টনার আছে, সবার সম্মতির ভিত্তিতে এগোতে হবে। এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।"