ইনভেস্টমেন্ট সামিট: ৬০টির বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তিন অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করবে

৭ থেকে ১০ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫। এ বিনিয়োগ সম্মেলন উপলক্ষে ৬০টিরও বেশি—অধিকাংশই বিদেশি—প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের উৎপাদন সম্ভাবনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরতেই এ উদ্যোগ।
বিডা কর্মকর্তারা জানান, ৭ ও ৮ এপ্রিল একদল বিদেশি বিনিয়োগকারী, তাদের উপদেষ্টা ও পরামর্শকরা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ও মিরসরাইয়ের ন্যাশনাল স্পেশাল ইকোনমিক জোন ঘুরে দেখবেন।
অন্যদিকে, আরেকটি দল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোন—যা জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল নামেও পরিচিত—পরিদর্শনে করবেন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা চাই, তারা সরাসরি গিয়ে জায়গাগুলো এবং সেখানকার সুবিধা নিজের চোখে দেখুক।'
তিনি আরও জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি 'বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা' কিছু দেশীয় উদ্যোক্তাকেও নিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
যেসব বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে যাবেন, তাদের একটি তালিকা এসেছে টিবিএসের হাতে। তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক জেপিজি ইনভেস্টমেন্টস, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাঙ্করলেস বাংলাদেশ ও সিনবাদ ক্যাপিটাল, এইচএসবিসি, চীনের রেইনমেকার ভেঞ্চারস ও ট্যালেন্টস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এলএলপি-র নাম রয়েছে।
এছাড়া নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরাও থাকবেন এই অর্থনৈতিক অঞ্চল সফরকারীদের দলে।
নির্মাণ, শিল্পোন্নয়ন, প্রকৌশল, জ্বালানি ও কেমিক্যাল খাতে কাজ করা চীন, সৌদি আরব, ভারত ও জাপানের কয়েক ডজন বিদেশি কোম্পানিও বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এবং ফেনীর সোনাগাজীতে ৩৩ হাজার ৮০৫ একর জমিজুড়ে বিস্তৃত দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল ন্যাশনাল স্পেশাল ইকোনমিক জোনকে (এনএসোইজেড) বাংলাদেশের ভবিষ্যতের শিল্প-হাব হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে বেজা।
এনএসইজেডে এশিয়ান পেইন্টস, বার্জার ও নিপ্পন ম্যাকডোনাল্ড স্টিলসহ মোট ১১টি কারখানা ইতিমধ্যেই উৎপাদনে গেছে। আরও ২৮টি কারখানা এখন নির্মাণাধীন।
এনএসইজেডের ১ হাজার একর জায়গাজুড়ে গঠিত সাব-জোনটি বেপজা পরিচালনা করছে। এই সাব-জোনে বিভিন্ন দেশের ৪১টি কোম্পানি কারখানা স্থাপনের জন্য লিজ চুক্তি সই করেছে। এর মধ্যে ২৪টি চীনা প্রতিষ্ঠান রেওচে, যারা যথাক্রমে ৮৬৭.২২ মিলিয়ন ডলার ও ৬১৪.৫৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বেজা কর্মকর্তারা জানান, 'প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে' অবস্থায় থাকা অন্য দুটি শিল্পাঞ্চল দ্রুত উৎপাদন শুরু করতে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে।
উদাহরণস্বরূপ, আনোয়ারায় ২ হাজার ৫০০ একর আয়তনের কোরিয়ান ইপিজেডে ইতিমধ্যে ৪৮টি অত্যাধুনিক উৎপাদন ইউনিটে প্রায় ৩৪ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে; যার মধ্যে আছে পোশাক রপ্তানিকারক জায়ান্ট ইয়ংওয়ানের কারখানাও।
আড়াইহাজারে ১ হাজার একর আয়তনের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতিমধ্যেই সিঙ্গারের একটি উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে আরও তিনটি কোম্পানির জন্য নির্মাণ চলছে। এছাড়াও প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে; আরও ৩০টি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারো কাওয়াচি বলেন, 'আমরা এখন এমন বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্ব দিচ্ছি, যারা পণ্য রপ্তানি করবে। এতে করে বাংলাদেশ এফডিআইয়ের আরও আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠবে।'
সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ইতিমধ্যে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন শুরু করেছে। কোম্পানিটি দৈনিক ১ হাজার ইউনিট ফ্রিজ ও টেলিভিশন উৎপাদন করছে। এই বহুজাতিক ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স কোম্পানিটি ৩৩.৪ একর জমিতে নির্মিত কারখানায় ৭৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
জাপানের শীর্ষস্থানীয় ভোক্তা পণ্য কোম্পানি লায়ন কল্লোল লিমিটেড এপ্রিল থেকেই উৎপাদনে যেতে প্রস্তুত। আরও কয়েকটি কোম্পানি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের কারখানা নির্মাণ শুরু করতে যাচ্ছে।
রপ্তানিমুখী উৎপাদনের জন্য কেমিক্যাল, খাদ্য, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও নির্মাণ সামগ্রীর মতো খাতের বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানি এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কাওয়াচি বলেন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এর সাফল্য নিয়ে তিনি আশাবাদী।
তিনি জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ আছে, গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কাজ চলতি বছরের মাঝামাঝি শেষ হবে।
বিডা ও বেপজা যৌথভাবে ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫ আয়োজন করছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এই সম্মেলনের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
আয়োজকদের তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যে ৫০টি দেশের ২ হাজার ৩০০-র বেশি অংশগ্রহণকারী সম্মেলনে যোগ দিতে নিবন্ধন করেছে; এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে ৫৫০-এর বেশি।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
'বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্র এবং সম্ভাবনার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া প্রয়োজন। এই সম্মেলন শুধু বিনিয়োগের সুযোগই তুলে ধরবে না, একইসঙ্গে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও তুলে ধরা হবে,' বলেন তিনি।