বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাড়ছে চীনা বিনিয়োগ: ২৪ চুক্তি স্বাক্ষর, পাইপলাইনে আরও ৩৪ প্রস্তাব

বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) জানিয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে চীনা বিনিয়োগ বাড়ছে। চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি ও প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজার।
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ৪১টি কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য লিজ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে ২৪টি চীনা কোম্পানি।
এসব প্রতিষ্ঠানের মোট প্রতিশ্রুত বিনিয়োগের পরিমাণ ৬১৪.৫৮ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চারটি চীনা কোম্পানি ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে সবগুলো বিদেশি কোম্পানি মিলিয়ে মোট প্রস্তাবিত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৬৭.২২ মিলিয়ন ডলার।
বেপজা জনিয়েছে, পাইপলাইনে প্রচুর চীনা বিনিয়োগ আছে।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে বেপজা ৩৪টি সম্ভাব্য চীনা বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫-এর মার্চ পর্যন্ত আটটি চীনা প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বেপজার সাথে লিজ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫৩.৮২ মিলিয়ন ডলার।
এই কোম্পানিগুলো সৌর যন্ত্রাংশ, ব্যাগ, লাগেজ, হালকা প্রকৌশল পণ্য, তৈরি পোশাক, সিলিকন-ডাই-অক্সাইড, ফ্লেক্সিবল ইন্টারমিডিয়েট বাল্ক কনটেইনার ও প্যাকেজিং তৈরি করতে চায়।
এর মধ্যে ইজিন বাংলাদেশ কোং লিমিটেড একটি জুতার অ্যাকসেসরিজ উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করার জন্য প্রস্তুত। অন্যদিকে হোম জয় সকস বাংলাদেশ কোং লিমিটেড একটি মোজা ও পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
চারটি চীনা কোম্পানি ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।
ফেংকুন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল কোং (বিডি) লি. বিনিয়োগ করছে ২.২ মিলিয়ন ডলার। কোম্পানিটি জুতার অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং উপকরণ উৎপাদন করে।
এছাড়া কাইজি, কেপিএসটি শুজ (বিডি) কোং লি. ও মিংডা (বাংলাদেশ) নিউ ম্যাটেরিয়ালস কোং লি.-ও এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদনে গেছে।
এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪৭.৫৫ মিলিয়ন ডলার।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, চীনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং চীনা পণ্যের ওপর সম্ভাব্য মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির কারণে কোম্পানিলো উৎপাদন কেন্দ্র স্থানান্তরের দিকে যাচ্ছে।
'ট্রাম্পের চীন নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। অতিরিক্ত কর দিতে হলে তাদের [চীনা প্রতিষ্ঠান] যে পণ্য আছে, সেই পণ্যের কিন্তু আমেরিকার বাজারে দাম অনেক বেড়ে যাবে। এর ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে তারা,' বলেন তিনি।
চীনে কর্মী সংখ্যা কমছে এবং মজুরি বাড়ছে উল্লেখ করে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারও চীনা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে।
তিনি আরও বলেন, 'এটা [প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া] এড়িয়ে যাবার জন্য চীনের কিছু বিনিয়োগকারী চাইছে চীনের বাইরে তাদের প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরিত করতে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, বাংলাদেশ—এই দেশগুলো তাদের পছন্দের।'
বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ
এদিকে বাংলাদেশ যখন বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইছে, তখন মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানি সংকটের কারণে বেশি পানি ব্যবহার হয় এমন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি।
জিয়াউর রহমান বলেন, 'একটি চীনা বিনিয়োগকারী টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান করতে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে না পারায় তাদের ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।'
মিরসরাইয়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা না থাকলেও পানির সমস্যা বড় চ্যালেঞ্জ।
বেপজা ইতিমধ্যেই ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ২৪৯টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। সেখানে খুব কম পানির প্রয়োজন হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এই সমস্যার সমাধানে বেপজার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ৪৫ একর জমিতে একটি লেক তৈরি করেছে। পাশাপাশি এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত দিয়েছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য 'রেইন ওয়াটার হারভেস্ট' করতে।
তবে বেপজা ইডি জানিয়েছে, বর্তমানে উৎপাদনে থাকা কারখানাগুলোতে এখন কোনো পানির সংকট নেই।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বেপজা আশা করছে, চীনা বিনিয়োগ তৈরি পোশাকের বাইরে নবায়নযোগ্য শক্তি ও সোলার প্যানেলের কাঁচামাল উৎপাদনের মতো খাতে বৈচিত্র্য আনবে।
৭ থেকে ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ চীনাদের আগ্রহ আরও বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২৩ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহ বেড়েছে।
আশিক বলেন, 'চীনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার সময় এখানে তাদের কারখানা স্থাপনের আগ্রহ বাড়ার ইঙ্গিত পাই।'
চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বৈদেশিক বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও উন্নত টেক্সটাইল উৎপাদনে।
উল্লেখ্য, চীন সফরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হাব হিসেবে তুলে ধরে চীনা ব্যবসায়ী নেতাদের এখানে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম, ঢাকা, মোংলা ও ঈশ্বরদীসহ আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) পরিচালনা করে বেপজা।
বেপজার সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ইপিজেডের ১০৭টি শিল্প ইউনিটে ১.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে ১ লাখ ৩৩ হাজার বাংলাদেশির জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।