নতুন বিনিয়োগের জন্য আস্থা যখন কম, তারমধ্যেও ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে আবুল খায়ের গ্রুপ

দেশে নতুন বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীক আস্থা কম হওয়ার মধ্যেও দমেননি আবুল কাশেম— যিনি দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আবুল খায়ের গ্রুপের চেয়ারম্যান। সাম্প্রতিক সময়ে তার নেতৃত্বে গ্রুপটি স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড কোম্পানির মাধ্যমে খাদ্য ও নিত্যপণ্য খাতেও ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরীণদের মতে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড এবং গ্লোব ফার্মার ভোজ্যতেল ব্যবসা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার চুক্তিতে অধিগ্রহণ করেছেন কাশেম।
এসব ক্রয় বা অধিগ্রহণের অংশ হিসেবে, আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারির (ইগলু সুগার নামেই বেশি পরিচিত) জন্য কাশেম অন্তত ১,৭০০ কোটি টাকা দিয়েছেন। আর গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডের জন্য দিয়েছেন ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। শেষোক্ত এই অধিগ্রহণের আওতায়, ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বেশ কয়েক একর জমিও আছে।
আবুল মোনেম গ্রুপের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বলেন, ক্রমাগত লোকসান দেওয়ায় চিনিকলটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। "সুগারমিল থেকে আমাদের লোকসান বাড়ছিল, তাই কার্যক্রম পরিচালনা করাই দায় হয়ে উঠছিল।" তিনি আরও জানান, বিক্রির থেকে আয়ের ৬০০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকের দেনা মিটিয়েছে শিল্পগোষ্ঠীটি, পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এর বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে।
দেশের সর্ববৃহৎ আইসক্রিম প্রস্তুতকারক ইগলুর মালিকানা প্রতিষ্ঠান আবুল মোনেম গ্রুপ। ইগলুর নিজস্ব চিনির চাহিদাও প্রচুর। কিন্তু, তা সত্ত্বেও বাজারে চিনির দাম সরকার নির্ধারিত হওয়ায় ব্যবসায় টিকতে পারছিল না গ্রুপটি। শীর্ষ ওই নির্বাহী বলেন, বেকারি ও বেভারেজের মতো ইন্টিগ্রেটেড ব্যবসার টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও বেশি, এই সুবিধাটা আমাদের গ্রুপের ছিল না।
আব্দুল মোনেম গ্রুপের চিনি পরিশোধনাগারের বার্ষিক পরিশোধন সক্ষমতা ৩ লাখ টন, যা কিনা বাংলাদেশের মোট চিনির চাহিদার আট ভাগের এক ভাগ। এই রিফাইনারির ব্যবস্থাপনার ভার এখন আবুল কাশেমের শিল্পগোষ্ঠীর হাতে।
গ্লোব গ্রুপ অব কোম্পানির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান– জিইওএল অধিগ্রহণও করেছেন আবুল কাশেম। এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে কার্বোনেটেড বেভারেজ, বিস্কুট ও ডেইরি পণ্যের ব্যবসা। তাদের পরিচিত দুটি ব্র্যান্ড হলো– ইউরো কোলা ও টাইগার সফট ড্রিংকস।
কোম্পানির ব্যবসায়িক পোর্টফলিও বেড়ে চলার কথা নিশ্চিত করেন স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে আমরা ভোজ্য তেল, পাম অয়েল, খাবার পানি, আটা, ময়দা ও সুজি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অধীনে বিক্রি করছি। এরমধ্যে স্টারশিপ সয়াবিন তেল, বাটারফ্লাই পাম অয়েল, সতেজ (খাবার পানি) ও এএমএ (আটা ও ময়দা)-র ব্র্যান্ড।
গত বছরের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যেই গ্লোব এডিবল অয়েল অধিগ্রহণ করে আবুল খায়ের গ্রুপ। গ্লোব গ্রুপের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ ও তার ভাই মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ কিরণ (নোয়াখালী-৩ আসনে আ. লীগের সাবেক এমপি) পতিত ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। কিরণ প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
কোম্পানির এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, "এখন তাঁরা ব্যবসা পরিচালনার মতো অবস্থায় নেই, বিশেষত সরকার পরিবর্তনের পর। তখন থেকে আমরাও আর তাদের দেখিনি।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে হারুন-অর-রশিদ ও মামুনুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও— তাদের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে আরেক পরিচালক সামির-আল- রশিদকে ফোন করা হয়, পাঠানো হয় ক্ষুদে বার্তাও। কিন্তু তিনি এতে সাড়া দেননি।
টিবিএস এবিষয়ে আবুল খায়ের গ্রুপের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। তবে কেউ অন-রেকর্ড কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, "এটা (স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড) আবুল খায়ের গ্রুপের কোনো ভেঞ্চার নয়, তাই এব্যাপারে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারছি না।"
তবে সংশ্লিষ্ট শিল্পের ব্যক্তিরা জানান, আরও কোম্পানি অধিগ্রহণের জন্য আলোচনা প্রক্রিয়ায় রয়েছেন আবুল কাশেম, যারমধ্যে খাদ্য, পানীয়, বিস্কুটখাতের প্রতিষ্ঠানও আছে। মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও টিকে গ্রুপের মতো বড় শিল্পগ্রুপগুলোর আধিপত্য রয়েছে এসব খাতে, সেখানে নিজ অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চান কাশেম।
আবুল খায়ের গ্রুপের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতার সবচেয়ে বড় ছেলে হলেন আবুল কাশেম। ১৯৭৮ সালে বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পরে তিনিই ব্যবসার হাল ধরেন। তাঁর নেতৃত্বে গ্রুপটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। সিমেন্টখাতে শাহ ব্র্যান্ড, স্টিল খাতে একেএস, ডেইরি খাতে মার্কস ফুল ক্রিম পাউডার, চায়ে সিলন এবং কনডেন্সড মিল্কে স্টারশিপের মতো ব্র্যান্ড নিয়ে বাজার আধিপত্য রয়েছে তাদের। গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার বা বিক্রি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বলে জানান প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণরা।
গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতার দ্বিতীয় পুত্র– আবুল হাশেম, বর্তমানে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেজ ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কনিষ্ঠ পুত্র শাহ শফিকুল ইসলাম একজন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।