‘আত্মজাগরণের নির্জন করিডর’

'আমি একা'–বাক্যটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে একধরনের দুঃখ, অসহায়ত্ব বা বিচ্ছিন্নতার অনুভব জেগে ওঠে। সমাজ আমাদের শিখিয়েছে, একা থাকা মানেই যেন অপূর্ণতা, যেন জীবনের সার্থকতা কেবল সম্পর্ক, সংযোগ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ভেতরেই নিহিত।
মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। বেঁচে থাকার তাগিদেই মানুষ বাস করে জোটবদ্ধ এক সামাজিক পরিস্থিতিতে; যার অনেকখানিই নির্ভর করে চাহিদা, নিরাপত্তা ও প্রত্যাশার ওপর।
মানুষের সমাজবদ্ধ এই ধারণা সামাজিকভাবে সত্য হলেও আত্মিকভাবে মানুষ আসলে একা।
একাকিত্বের বীভৎস যে রূপটা সমাজ আমাদের দেখায়, তা থেকেই বোধ করি একাকিত্বের প্রতি তৈরি হয় প্রবল এক ভীতি।
একাকিত্ব এক ভীতিপ্রবণ সংস্কার হয়ে আমাদের মধ্যে থেকে যায়। আমরা তাকে তার স্বরূপে কখনো দেখি না। উপভোগ করি না।
কিন্তু এই সংস্কার ভাঙে তখন, যখন আমরা বুঝতে শিখি একা থাকা মানেই একাকিত্ব নয়। আবার একাকিত্বে ভোগা মানে নিঃসঙ্গতায় ভোগা নয়।
একাকিত্ব হচ্ছে নিজেকে নির্মাণের এক প্রশস্ত রাস্তা।
আগের আধ্যাত্মিক দর্শনেও একাকিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি। বরং এটিকে ধ্যান ও মুক্তির এক অনিবার্য শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
যোগসূত্রে বলা হয়, 'চিত্ত-বৃত্তি-নিরোধ'–চিন্তার তরঙ্গ যখন স্তব্ধ হয়, তখনই প্রকৃত আত্মদর্শন ঘটে। এই স্তব্ধতা, এই নীরবতা তখনই সম্ভব, যখন আমরা বাহ্যিক সম্পর্ক ও শব্দের জগৎ থেকে অন্তরে প্রত্যাবর্তন করি।

বুদ্ধের কথাই স্মরণ করা যাক–তিনি বোধিগাছের নিচে একা বসে নিজের মধ্যেই প্রবেশ করেছিলেন। না ছিল কোনো গুরু, না কোনো সঙ্গ। তার মুক্তি এসেছিল সেই একাকিত্বের মধ্য দিয়েই।
আরও কত মুনি ঋষিরা গেছেন হিমালয়ে, কবিরা আলো জ্বেলে বসে থেকেছেন নির্জন কুঠুরিতে, মহানবী (সা.) অবস্থান করেছেন হেরা গুহায়। এগুলো সকলই একাকিত্বকে বেছে নেওয়ার উদাহরণ। ফল কী হয়েছিল, সেসবও আমাদের অজানা নয়।
নিজেকে ভালোবাসারও পূর্বশর্ত হলো নিজের সঙ্গে সময় কাটানো। আমরা যখন নির্জনতায় থাকি, তখনই ধরা দেয় আমাদের চিন্তার আসল গতিপথ, আমাদের গভীরতম ইচ্ছা এবং সেসব না-বলা ব্যথা, যেগুলো কোলাহলে চাপা পড়ে যায়।
এই একাকিত্বই তৈরি করে চেতনার সেই স্বচ্ছ আয়না, যেখানে আমরা দেখতে পাই আমাদের অহং কোথায়, আমাদের ভয় কী এবং আমরা কিসের জন্য বাঁচতে চাই।
হেমিংওয়ে বলেছিলেন, 'সৃজনশীলতার জন্য একাকিত্ব অপরিহার্য।'
একাকিত্বকে বলা যায় 'আত্মিক নির্জনতা', নিঃসঙ্গতার বিপরীতে অবস্থান করে। একাকিত্ব ঠিক বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং একধরনের পূর্ণতার অনুভব। যেখানে মানুষ নিজেকে নিরাভরণ ও নিরবিকল্পভাবে উপলব্ধি করে।
নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব দুটি শব্দ, দুটি অনুভূতি, দুটি বিপরীত জীবনদর্শন।
শব্দে পার্থক্য ক্ষীণ হলেও অন্তর্নিহিত অর্থে এরা যেন আকাশ আর পাতাল। নিঃসঙ্গতা এমন এক অভিজ্ঞতা, যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। একটা অনিচ্ছাকৃত শূন্যতা, যেখানে আমরা ডুবে যাই না চেয়েও। অন্যদিকে একাকিত্ব হলো নিজের বেছে নেওয়া নীরবতা, যেখানে আমরা ফিরে যাই নিজের ভেতরে।
একাকিত্ব অবিভাজ্য, কিন্তু নিঃসঙ্গতা বিচ্ছিন্নতা।
নিঃসঙ্গতা আসে বিচ্ছিন্নতা ও ভয় থেকে–একটি অনুভব যা বলে দেয়, 'আমি কারও সাথে নেই, কেউ আমার নেই।' এটি জন্ম নেয় আত্মকেন্দ্রিকতা, ব্যর্থ সম্পর্ক, সামাজিক বিচ্ছেদের ভেতর থেকে। আমরা এই যন্ত্রণার থেকে পালাতে চাই–ধর্ম, বিনোদন, প্রযুক্তি, এমনকি ঈশ্বরকেও ব্যবহার করি আরাম খোঁজার মাধ্যম হিসেবে।
শহরের কোলাহলে শত সহস্র মুখের মাঝেও মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ হতে পারে, তা আসলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
তথ্য বলছে, নিঃসঙ্গতা এখন একটি বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্যসংকট।
যুক্তরাজ্য ও জাপানে নিঃসঙ্গতাবিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ একুশ শতকের উন্নত নগরসভ্যতার আত্মঘাতী দিকটি প্রকাশ করে।
মানুষের চারপাশে মানুষ থাকলেও হৃদয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ক্রমে।

প্রযুক্তি এসে আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, এ কথা সত্য।
ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–সব মিলিয়ে আমরা যেন আর কখনো একা নই।
কিন্তু এই সংযোগ কি সত্যিই আমাদের অন্তর্জগতের নিঃসঙ্গতা দূর করতে পেরেছে? নাকি এই সংযোগের ছদ্মবেশে আমরা আরও গভীর নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাচ্ছি?
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির সময় প্রযুক্তিই হয়ে উঠেছিল জীবনের বড় একটা কেন্দ্রস্থল। কিন্তু সেই অনলাইননির্ভরতা এখনো রয়ে গেছে অভ্যাসে। ফলে আমরা বাস্তব সম্পর্কের চেয়ে ভার্চুয়াল সংযোগে সময় কাটাচ্ছি বেশি এবং ফলাফল? আরও ভাঙা সম্পর্ক, আরও বিষণ্নতা, আরও নিঃসঙ্গতা।
২০২৩ সালে গ্যালাপ পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানা যায়, প্রতি ছয়জন প্রাপ্তবয়স্কের একজন প্রতিদিন নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করেন। অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে গেছে, যেখানে সবাই কিছু না কিছু করছে–ভ্রমণ, উৎসব,আনন্দ...।
আর আমরা যারা নিঃশব্দে দিন কাটাই, আমাদের মনে হয়, যেন কিছু মিস করছি।
এই 'FOMO—Fear of Missing Out' আমাদের মানসিকতাকে করে তোলে আরও দুর্বল, আরও নিরাপত্তাহীন। আজকের দিনে আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে ফাঁকা সময় মানেই ফোনে মুখ গুঁজে থাকা। কিন্তু এই পর্দার আড়ালে কি আছে সত্যিকারের সম্পর্ক?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না, বরং এই আচরণ আমাদের আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে, মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে নিজের থেকে। ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে জীবন বোধকে।
অন্যদিকে একাকিত্ব কোনো পালানো নয়, বরং এক সচেতন বেছে নেওয়া। এটি সমস্ত পরিচিত ও সামাজিক প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করা–পরিবার, সংস্কৃতি, ধর্ম এমনকি নিজের অবচেতন চাহিদার বন্ধন থেকেও। এই একাকিত্ব আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়, যেখানে আত্মপরিচয়ের গভীর উপলব্ধি জন্ম নেয়।
মানব অস্তিত্বের একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো, 'আমরা কি আদতে একা?' জ্যাঁ-পল সার্ত্র বলেছেন, 'মানুষ স্বাধীনতার জন্য দণ্ডিত।'
এই 'দণ্ডিত' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে; কারণ, মানুষ নিজেকে সৃষ্টি করেনি–তার অস্তিত্ব তার নিজের ইচ্ছার ফসল নয়।
তবু সে স্বাধীন; কারণ, একবার যখন তাকে এই জগতে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে, তখন থেকে সে নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি কাজের জন্য পুরোপুরি দায়বদ্ধ।
অস্তিত্ববাদীরা একাকিত্বকে কোনো অবাধ্য, নিয়ন্ত্রণহীন ঝড় বলে মনে করেন না। বরং জীবনের এক অন্তর্গত উদ্দেশ্য হিসেবেই দেখেন।
মানুষের ভেতরকার শূন্যতা যখন মানুষকে ঠেলে নিয়ে যায় একাকিত্বের দিকে, তখনই আসলে এক বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম হয়।
জাঁ পল সার্ত্রে, মার্টিন হাইডেগার প্রমুখ অস্তিত্ববাদীরা মনে করেন, মানুষের অস্তিত্বের মূলে এক অন্তরাল নির্জনতা রয়েছে। আমরা জন্মাই একা, বাঁচি একা এবং মরিও একা। এই সত্যকে অস্বীকার করলে আমরা পরনির্ভরতার গোলকে আটকে যাই। কিন্তু একে যদি গ্রহণ করি, তাহলে জীবনের অর্থ, গঠন ও সৌন্দর্য নতুনভাবে ধরা দেয়।
তারা বিশ্বাস করেন না যে প্রবল একাকিত্ব কোনো ভয়ংকর প্রবাহের মতো নয়, বরং এ এক আত্মজ্ঞান, যা নিজেকে চিনতে এবং নিজের আরও মুখোমুখি করে তোলে।

এই বিষয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক অভিমত আর্থার শোপেনহাওয়ারের। তিনি বলেন, 'মানুষ শুধু তখনই নিজের হতে পারে, যখন সে একা থাকে। যদি সে একাকিত্বকে ভালো না বাসে, তবে সে স্বাধীনতাকেও ভালোবাসবে না; কারণ, স্বাধীনতা শুধু একাকিত্বেই পাওয়া যায়।' সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তি চিরকালই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়, ফলে সত্যিকারের স্বাধীনতা হয়ে পড়ে দুর্লভ। অন্যদের স্বীকৃতি ছাড়া নিজেকে দৃশ্যমান মনে করা কঠিন। কিন্তু শোপেনহাওয়ারের মতে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো ভয়ের বিষয় নয়; বরং এটা নিজেকেই নিখাদভাবে জানার উপায়। একাকী মন মানে এক মুক্ত মন, যেটি অন্যদের প্রভাবমুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে। তাঁর মতে, 'বাহ্যিক ইন্দ্রিয় থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মনের সক্রিয়তা বাড়ে। দীর্ঘ একাকিত্ব, কারাগারে থাকা, অসুস্থ কক্ষে নিঃস্তব্ধতা, সান্ধ্য, অন্ধকার–সবই মানসিক সৃজনশীলতাকে বাড়ায়।'
তবে শোপেনহাওয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর বিখ্যাত নিঃসঙ্গবাদী চিন্তার সঙ্গেও যুক্ত, যেখানে মানবজীবন এক নিষ্ফল প্রচেষ্টা, যা এক উদাসীন বিশ্বের দিকে ধাবমান। জীবন কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থ বহন করে না; যেটুকু অর্থ আমরা নিজে দিই, তা বিশ্বের কাছে অর্থহীন। নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা হয়তো আমাদের ব্যর্থতার অনুভব–জগৎ থেকে গভীর সংযোগ না গড়ার কারণে। শোপেনহাওয়ারের মতে, এটি কোনো ব্যর্থতা নয়; কারণ, জীবনের কোনো অন্তিম লক্ষ্যই নেই। সুতরাং, নিঃসঙ্গতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ারও কোনো দরকার নেই। বরং এটি একধরনের মননচর্চার সুযোগ, একটি সৃজনশীল মানসিক পরিসর।
জার্মান দার্শনিক কার্ল ইয়াং বলেছিলেন: 'যারা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা স্বপ্ন দেখে, যারা নিজের ভেতরটাকে দেখতে পায়, তারাই জেগে থাকে।'
নিজের ভেতরের দিকে তাকাতে গেলে আমাদের একা থাকতে হয়।
একা সময় কাটানো মানেই নিজেকে বুঝতে শেখা।
আমাদের আবেগ, ভয়, অভ্যাস, ক্ষত–সবকিছু আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
আধুনিক থেরাপি যেমন জার্নালিং, মাইন্ডফুলনেস, সাইলেন্ট রিট্রিটস ইত্যাদির মূলেই রয়েছে একাকিত্বের চর্চা। এটি শুধু আত্মজ্ঞান নয়, বরং আবেগগত আরোগ্যের পথও খুলে দেয়।
একটা সময় আসে, যখন মানুষ বুঝতে শেখে, জীবনের প্রকৃত অর্থ কোনো প্রাপ্তি বা সামাজিক সাফল্যের মধ্যে নয়, বরং নিজেকে জানার, বোঝার, আর গ্রহণ করার গভীরতাতেই তা নিহিত। সেই উপলব্ধি, সেই সত্তা-দর্শন সম্ভব হয় শুধু নির্জনে। কোলাহল নয়, নীরবতাই আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
শিল্পী, দার্শনিক, সাধক, যারা সত্যের খোঁজে নেমেছিলেন, তারা সবাই কোনো এক পর্যায়ে একাকিত্বকে বরণ করেছেন। ঈশ্বর, শিল্প, প্রেম, জ্ঞান–সবকিছুর গভীর অভিজ্ঞতা এসেছে, যখন তারা ভিড় থেকে সরে গিয়ে নিজের ভেতরে ফিরে গেছেন।
আজকের এই প্রযুক্তিমুখী, মোহগ্রস্ত সমাজে একাকিত্ব প্রার্থনা একধরনের বিদ্রোহ, একধরনের আত্মরক্ষা, যা আমাদের টেনে আনে শিকড়ে, আত্মার গভীরে।