কেন অ্যাম্বার-ডেপকে নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে?

হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ গত ১ জুন প্রাক্তন স্ত্রী এবং অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ডের বিরুদ্ধে করা মানহানি মামলায় জিতেছেন। আদালতের জুরিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হার্ডের কাছ থেকে ডেপ দেড় কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ পাবেন। এর মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক কোটি ডলার (compensatory damages) এবং শাস্তিমূলক ক্ষতিপূরণ (punitive damages) হিসেবে ৫০ লাখ ডলার। তবে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের শাস্তিমূলক ক্ষতিপূরণের সীমারেখা অনুযায়ী বিচারক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ডেপ ১.৩৫ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ পেতে যাচ্ছেন।
একইসাথে ডেপের বিরুদ্ধে আনা কিছু অভিযোগের রায় হার্ডের পক্ষে গেছে। জুরিরা প্রমাণ পেয়েছেন, ডেপের সাবেক আইনজীবী অ্যাডাম ওয়াল্ডম্যান হার্ডের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অবমাননাকর বিবৃতি দিয়েছেন। এজন্য জুরি প্যানেল নির্দেশ দিয়েছেন যেন জনি ডেপ অ্যাম্বার হার্ডকে ২০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেন।
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে জনি ডেপের জন্য এটি বিশাল জয়। পাশাপাশি এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টিতে গত ১১ এপ্রিল শুরু হওয়া মানহানির এ মামলার বিচারকাজটি দ্রুতই মিডিয়া সেনসেশনে পরিণত হয়। টুইটারে বিচার-সংক্রান্ত বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হওয়া থেকে শুরু করে ফেসবুকে যাবতীয় মিম, টিকটকে ট্রল – সবই হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সমস্যা যেমন বিগত কয়েক সপ্তাহে স্কুলে-হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ম্যাস শ্যুটিং – এমন ঘটনাবহুল একটি সময়েও আলোচনার শীর্ষে ছিল হার্ড-ডেপের মামলার এই বিচারকাজ।
জনপ্রিয় তারকাদের বর্ণিল জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন অন্ধকার বাঁক, জনসমক্ষে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রকাশ্য ব্যবচ্ছেদ, একে অন্যের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি – মূলত এ উপাদানগুলোই এটিকে চলতি বছরের অন্যতম চর্চিত একটি ঘটনা করে তুলেছে। বহুল আলোচিত এই মামলার আদ্যোপান্ত, বিশেষত এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
প্রেক্ষাপট
মানহানি মামলাটির প্রেক্ষাপটের কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই চলে আসে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার জন্য লেখা অ্যাম্বার হার্ডের একটি উপসম্পাদকীয়'র কথা। সেই মতামত আর্টিকেলটিতে তিনি লিখেছিলেন, 'তারপর দু' বছর আগে, আমি ঘরোয়া সহিংসতাকে প্রতিনিধিত্ব করা একজন পাবলিক ফিগারে পরিণত হই...' ('Then two years ago, I became a public figure representing domestic abuse, and I felt the full force of our culture's wrath for women who speak out.')।
উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন পোস্টের এই অপিনিয়ন পিসটিতে হার্ড নিজেকে 'ভিক্টিম' বলে নয়; বরং একজন 'পাবলিক ফিগার' বলে দাবি করেছেন। একইসাথে তিনি সরাসরিভাবে ডেপের নাম উল্লেখ করেননি এবং ঠিক কোন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তা বলেননি। তবে হার্ড এখানে সরাসরিভাবে জনি ডেপের নাম উল্লেখ না করলেও, ডেপ দাবি করেছেন যে এর কারণে লোভনীয় কিছু অভিনয়ের প্রস্তাব তার হাতছাড়া হয়েছে। বিজ্ঞাপন থেকেও তাকে অপসারণ করা হয়েছে। আর্টিকেলের এই বাক্যটির প্রথমার্ধকে, এই ১২টি শব্দকে জের ধরে জনি ডেপ পরবর্তীতে ৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে হার্ডের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন।
যদিও প্রথম দেখায় এটিকে স্রেফ সংবাদপত্রের একটি লেখার উপর করা মানহানির মামলা মনে হয়, তবু দিনকে দিন এখানে আরো জটিলতা বেরিয়ে এসেছে। ডেপ এবং হার্ড দু'জনই একে অপরের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ এনেছেন। কোনটি কতটুকু সত্য – তার ধোয়াশা এখনো পুরোপুরিভাবে কাটেনি।
'পাইরেটস অন দ্য ক্যারিবিয়ান' ফ্র্যাঞ্চাইজের পরিচিত মুখ জ্যাক স্প্যারো চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসেন জনি ডেপ। সিরিজটির প্রথম পাঁচটি সিকুয়েলেই ছিলেন তিনি। তবে ষষ্ঠ সিকুয়েলটির জন্য তিনি যে ডিজনি থেকে আর ডাক পাননি, তার জন্য তিনি দায়ী করেছেন হার্ডের সেই উপ-সম্পাদকীয়কে। হার্ড সেখানে পরোক্ষভাবে যে ডেপকে দায়ী করেছেন, সেটির কারণেই ডিজনি ডেপের সাথে নতুন কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না – এমনটি দাবি করেছেন জনি ডেপ।
নব্বইয়ের দশকের অন্যতম হার্ট্রথ্রব হওয়ার পাশাপাশি এডওয়ার্ড সিজরহ্যান্ডস, হোয়াট'স ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ, ডনি ব্রাস্কো, ডেড ম্যান, ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ড -র মতো এমন কিছু ছবি ডেপ দর্শককে উপহার দিয়েছেন যা সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়িয়েছে। জর্জ ক্লুনি, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, ব্র্যাড পিটদের চেয়ে জনপ্রিয়তায় কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু ২০১০ এর দশকে এসে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। একইসাথে তার ব্যক্তিগত জীবনেও নানাবিধ সমস্যা, বিশেষ করে, আর্থিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটে তখন।
রোলিং স্টোনের এক প্রোফাইল আর্টিকেল জনি ডেপের নিন্দা করে তাকে বিস্মৃতপ্রায় আইকন হিসেবে উপস্থাপন করে এসময়। অর্থ-খ্যাতি-মাদকাসক্তির কারণে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি দেওলিয়া হওয়ার পথে, নিঃস্ব-প্রায় এমনটি দাবি করেছিল সেই আর্টিকেল।
অন্যদিকে, ২০০৮ এ জাড অ্যাপাটাও'র পাইনঅ্যাপল এক্সপ্রেস-এ পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই হার্ডের মূলধারার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। এরপরের বছরই 'দ্য রাম ডায়েরি' ছবির সেটে জনি ডেপের সাথে প্রথম দেখা হয় তার। দু'জনই সেসময় অন্যদের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। ছবিটি পরে ২০১১ সালে মুক্তি পায়। নিজেদের মাঝে তাদের বয়সের ব্যবধান দুই দশকেরও বেশি। হার্ড তখন সবেমাত্র খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করেছেন।
এরপর কয়েকটি ছবিতে মূল ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি ২০১৭ সালে ডিসি কমিকসের 'অ্যাকুয়াম্যান' ফ্র্যাঞ্চাইজের মীরা চরিত্রটি বগলদাবা করেন। এখন পর্যন্ত এটিই তার অভিনীত সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র।
২০১২ সালে অ্যাম্বার হার্ড এবং জনি ডেপ সম্পর্কে জড়ান এবং এর তিন বছর পর এ জুটি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মাত্র ১৫ মাস সংসার করার পর ২০১৬ সালের মে মাসে বিচ্ছেদের আবেদন করেন এই তারকা দম্পতি। হার্ড ডেপের বিরুদ্ধে সেসময়ই প্রথমবারের মতো ঘরোয়া সহিংসতার অভিযোগ এনেছিলেন। ডিভোর্সের আবেদন করার চারদিনের মাথাতেই জনি ডেপ যেন তার আশেপাশে না আসতে পারেন, সেজন্য রেস্ট্রেইনিং অর্ডারের অনুরোধ করেছিলেন এবং সাময়িক সময়ের জন্য তা পেয়েছিলেনও।
গণমাধ্যমেও সেসময় এ ঘটনা নিয়ে বেশ কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালের শুরুর দিকে এক পক্ষ যখন আরেক পক্ষের দিকে অভিযোগ এনে চলছিল, তাদের বিচ্ছেদের নিষ্পত্তির কিছুটা সময় পর তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। তখনকার অবস্থা দেখে আঁচ করা সম্ভব হয়নি যে এই হার্ড-ডেপ ইস্যু পরবর্তীতে আবার উঠে আসবে।
কিন্তু এসেছে। ২০১৭ এর অক্টোবরে যখন হলিউড প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আসতে শুরু করে, তখন এই মুলুকের পট-পরিবর্তন খুব দ্রুতই ঘটে। হলিউডের নানা স্তরে প্রতাপশালী লোকেরা নারী তারকাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার অপব্যবহার করছেন এবং একইসাথে পার পেয়ে যাচ্ছেন, এই ধারণাটি জোরদার হয়। হ্যাশট্যাগ মি-টু দ্রুতই একটি আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই হার্ড তার প্রাক্তনের বিরুদ্ধে কেন ঘরোয়া সহিংসতার অভিযোগ আনেন, তা নিয়ে নতুনভাবে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়।
এসিএলইউ (অ্যামেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন) -এর নারী অধিকারের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মনোনীত হওয়ার পাশাপাশি ২০১৮ এর ডিসেম্বরে হার্ড ওয়াশিংটন পোস্টের জন্য উপসম্পাদকীয়টি লিখেন। কিন্তু এর তিন মাস পরই ২০১৯ এর মার্চে ডেপ মানহানির অভিযোগে ৫ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে হার্ডের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। ২০২১ এর জানুয়ারিতে হার্ড আবার ১০ কোটি ডলারের পাল্টা মামলা করেন যেটির বিচারকাজ হয়তো চলতি বছরই ভার্জিনিয়াতে শুরু হবে। এখানে উল্লেখ্য, যে বিচারকাজটি শেষ হল এবং ডেপের পক্ষে রায় এল, সেটি ডেপ যে হার্ডের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন, সেটির ফলাফল।
বর্তমান রায়টির পরপরই অ্যাম্বার হার্ড এবং জনি ডেপ পৃথকভাবে বিবৃতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া জানান। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সমর্থনের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার পাশাপাশি ডেপ লিখেন, 'জুরিরা আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন।' তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আরো অনেক নির্যাতিত নর-নারী যারা সহিংসতার পরও নীরব থেকেছেন, তারা সামনে এগিয়ে আসার সাহস পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। একইসাথে লাতিন ভাষায় যোগ করেছেন যেটির অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এরকম: 'সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী'।
পক্ষান্তরে হার্ড বিবৃতিতে জানান, 'আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। ... আমার হৃদয় ভেঙে গেছে এটা দেখে যে, পাহাড়সম প্রমাণাদিও আমার প্রাক্তন স্বামীর বিপুল ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তির সামনে দাঁড়াবার জন্য যথেষ্ট ছিল না।' হার্ডকে মানহানির মামলার জন্য যে জরিমানা করা হয়েছে, তা তিনি পরিশোধ করতে পারবেন না বলে সম্প্রতি তার আইনজীবী এলেইন ব্রেডেহুফট জানিয়েছেন।
জনি ডেপ ২০১৮ সালে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড 'দ্য সান' পত্রিকার বিরুদ্ধেও মামলা করেছিলেন কারণ একটি আর্টিকেলে ট্যাবলয়েডটি ডেপকে স্ত্রী পেটানোর ("wife beater") অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। সেটির বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় লন্ডনে, ২০২০ সালে; তখন 'দ্য সান' পত্রিকার উপর ভার ন্যস্ত ছিল যে ডেপ যে আসলেই তার স্ত্রীকে পিটিয়েছেন, তা প্রমাণ করে দেখানো। মামলায় তাই অ্যাম্বার হার্ডের নাম উল্লেখ না থাকলেও, পত্রিকাটি হার্ডকে সেখানে পেশ করে।
তিনি তখন ডেপের করা ১৪টি সহিংসতার ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন। আদালত সেই যাত্রায় ডেপের বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন যে ডেপ তার প্রাক্তন স্ত্রীকে পিটিয়েছেন এবং এর কিছু সময় পরই জনি ডেপকে 'ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস'-র ফ্র্যাঞ্চাইজে থেকে অপসারণ করা হয়।
এখন পাঠকের মনে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে যুক্তরাজ্যে মানহানির মামলায় হেরে ডেপ যুক্তরাষ্ট্রে আবার জিতলেন কীভাবে?
একদম সহজভাবে বললে, যুক্তরাজ্যে যখন ডেপ মামলাটি লড়েছিলেন, তখন তার বিচার করেছেন একজন বিচারক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে একটি জুরি তার বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন। মূলত এর সাথে সংশ্লিষ্ট কারণগুলোই দু'টো রায়ে তফাতটুকু গড়ে দিয়েছে। এ ছাড়া লন্ডনে বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে মিডিয়া কাভারেজ ছিল সীমিত।
আর ভার্জিনিয়ার বিচারিক কার্যক্রমের বেলায় এটি সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক চর্চিত বিষয়ের একটিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ আদালত প্রাঙ্গণের বাইরেও বিচার কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। জুরি সদস্যদের কাছেও মুঠোফোন ছিল, তাদেরকে জনজীবন থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব থেকে তারা পুরোপুরিভাবে মুক্ত ছিলেন না।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রে মানহানির মামলায় জয়লাভ করা ডেপের জন্য বেশি কষ্টসাধ্য ছিল। কারণ এখানে বাদীপক্ষকে মানহানি করা হয়েছে এটি প্রমাণ করতে গিয়ে অন্তত দু'টো জিনিসের সত্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
- বাদীকে প্রমাণ করতে হবে, তার বিরুদ্ধে যে বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছে সেটি মিথ্যা;
- বাদীকে 'অসৎ উদ্দেশ্য' (actual malice) নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
অর্থাৎ বাদীর বিপক্ষে যখন মানহানিকর বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছে, তখন যিনি বা যারা এ বিবৃতিটি দিয়েছেন, তারা জানতেন এটি মিথ্যা। কিন্তু বাদীর ক্ষতিসাধন করার জন্য এটি বলেছেন। মার্কিন আইন অনুযায়ী, এই দু'টো বিষয় প্রমাণ করতে পারলে কেবল তবেই কেউ মানহানির মামলায় জয়লাভ করতে পারে। ডেপের আইনজীবীরা এই দু'টো বিষয়ই ভার্জিনিয়ার আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া চলার সময় প্রমাণ করেছেন যে জনি ডেপের বিরুদ্ধে অ্যাম্বার হার্ড যে ঘরোয়া সহিংসতার অভিযোগটি ওয়াশিংটন পোস্টের সেই লেখাটিতে এনেছিলেন তা ছিল মিথ্যে, এবং সেই বিবৃতিটি দেওয়ার পেছনে ডেপকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অসৎ উদ্দেশ্য ছিল।
হার্ড এবং ডেপের এ ট্রায়ালটির একটি দিক বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। পুরো ট্রায়ালকে ঘিরে ফেসবুক, টিকটক, টুইটারে মিম শেয়ারিংয়ের খেলায় মানুষকে মত্ত হয়ে উঠতে দেখা গেছে, তার উপর বিচারকাজটিকে নিয়ে স্যাটারডে নাইট লাইভ অনুষ্ঠান এর প্যারোডি তৈরি করেছে। অর্থাৎ এটিকে অনেকেই একটি হাস্যরসাত্মক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
হার্ড তার সাথে হওয়া সহিংসতার ব্যাপারে মিথ্যাচার করেছেন, এমন ধারণা অনেকের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে অনেক কন্সপিরেসি থিওরির অবতারণা ঘটতে দেখা গেছে যদিও এর সত্যতা এখনো নিশ্চিত বা প্রমাণিত না। ছয় সপ্তাহ স্থায়ী এই ট্রায়ালটির অনলাইনে লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের স্পর্শকাতর তথ্য যেভাবে সবার গোচরে এসেছে, হাস্যরসে পরিণত হয়েছে, সাধারণ শিষ্টাচার কিংবা সমানুভূতির কোনো বালাই সেখানে ছিল না।
ভুলে গেলে চলবে না যে এটি অত্যন্ত গুরুগম্ভীর একটি ইস্যু; ঘরোয়া সহিংসতা, দাম্পত্য কলহ, টক্সিক সম্পর্কের বহু রূপভেদ এখানে উঠে এসেছে। চরম ডানপন্থী এবং উগ্রবাদীদের অনেকেই এটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে, সেই চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। এই ট্রায়াল হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলনের সফলতা কিংবা অগ্রযাত্রাকে অনেকটা মন্থর করে দিতে পারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নারীবিদ্বেষ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে – এমন উৎকণ্ঠাও এখন অনেকের মাঝে বিরাজ করছে। তবে ডেপের বিরুদ্ধে হার্ড যে পাল্টা মামলাটি করেছিলেন, তার বিচারকাজ এখনো বাকি।
এখনো তাদের সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ জটলা থেকে গেছে। তা-ও বলা যায় যে দু'জনের সম্পর্কের সূত্রপাত যেভাবেই হোক না কেন, সেখানে পরবর্তীতে তীব্র রকমের তিক্ততা এবং বিষাক্ততা কাজ করেছে। সম্পর্কে থাকাকালীন অবস্থায় ডেপ তার প্রাক্তন প্রেমিকা এবং ব্রিটিশ সুপারমডেল কেট মসকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন – ভার্জিনিয়ার আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে হার্ড তার শোনা এই গুজবটির কথাও তুলেছিলেন। তবে কেট মসকে আদালতের সামনে হাজির করার পর তিনি জানিয়েছেন যে ডেপ কখনোই তার প্রতি সহিংস হননি।
আদালতে ডেপের আইনজীবীরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, অ্যাম্বার নিজেই ডেপকে অত্যাচার করতেন। তারা একটি অডিও ক্লিপ পেশ করেছেন, যেখানে অ্যাম্বার জনি ডেপকে বলছেন, 'বাইরে গিয়ে বলো জনির বউ জনিকে মারে, কে বিশ্বাস করে দেখি'! এ ছাড়া একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে অ্যাম্বারকে স্বীকার করতেও শোনা গেছে তিনি নিজে ডেপকে মারধর করতেন।
পুরুষ নারীর দ্বারা নির্যাতিত হতে পারেন এবং হনও – এটি সত্য এবং প্রাসঙ্গিক। সাধারণ মানুষ প্রায়শ এটি ভুলে যান কিন্তু খ্যাতির শীর্ষে থাকা একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতায় এটি সত্য হতে পারে। এই মামলার বিচারকার্য চলাকালে উত্থাপিত বিভিন্ন অডিও কিংবা ভিডিও ফুটেজ সেই সত্যটিকেই আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।