গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলন ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাত ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করে বেশ একটা হইচই ফেলে দিয়েছেন। কারণ দেশে এ যাবতকালে যতো ধরনের বিপদ বা সংকট সৃষ্টি হোক না কেন, গভীর রাতে কেউ সংবাদ সম্মেলন করেননি। কিন্তু দেশের চলমান অপরাধ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী হঠাৎ ও তড়িঘড়ি করে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, তিনি সংবাদ সম্মেলনের জন্য কেন এরকম অস্বাভাবিক একটা সময় বেছে নিলেন? এক হতে পারে– দুর্ধর্ষ ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি সবকিছু এই রাতেই ঘটে– সেগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে উনিও রাতে সজাগ হয়েছেন। অথবা সংবাদ সম্মেলনে একটা অভিনবত্ব আনার জন্য তিনি এই ক্ষণ বেছে নিয়েছেন। অথবা উপর্যুপরি সমালোচনার মুখে, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। তাই 'যা তুমি মধ্যরাতে করতে পারো, তা কেন সকালের জন্য ফেলে রাখবে' এই প্রবচনের ওপর ভিত্তি করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আমরা স্যারের এই উৎসাহ ও দায়িত্বপালন করার আগ্রহকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। উনি ওয়াদা করেছেন আজ (সোমবার) থেকে অবশ্যই অবস্থার উন্নতি হবে। তবে উনি গোড়ায় যে গলদটি করেছেন, সেটা থেকে সরে না এলে কোনো ফল লাভ হবে না।
যেমন– উনি দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেছেন, 'যে কোনো অবস্থায় এটা প্রতিহত করবে সরকার।' তাহলে ধরে নিতে হবে এইসব ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা আওয়ামী লীগের দোসরারা সৃষ্টি করছে। এইটা জানার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এতগুলো স্ট্রং টিম বসে আছে কেন? কেন 'ডেভিল হান্ট অপারেশন' চালানোর মাধ্যমে শত শত 'সন্ত্রাসী' আটকের পরেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না?
আওয়ামী লীগ পালানোর পর ৭ মাস পার হয়ে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, অধিকাংশই পালিয়ে গেছে বা জেলহাজতে ঢুকেছে। তাহলে ওরা কীভাবে এত অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, 'দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা আওয়ামী লীগ এ কাজে ব্যবহার করছে। এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার।' আমরা ওনার পক্ষে আছি। কারণ আমরা সুস্থ ও নিরাপদ জীবন চাই।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে পদত্যাগের কোনো ইতিহাস নাই, কাজেই দেশবাসী আশা করতে পারেন না যে, স্যার এই ছোটখাটো ইস্যুকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করবেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও অবশ্য এই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। তাকে যখন পদত্যাগের দাবির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়েছে, 'আপনার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে কিছু সময় আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন, সমাবেশ করেছেন। তারা আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন আপনার পদত্যাগের জন্য। এ বিষয়টি কি আপনার নজরে এসেছে?'
জবাবে উপদেষ্টা যা বলেছেন, তা একদিকে যেমন স্মার্ট, তেমনি হাস্যকর। তিনি বলেছেন, 'তারা আমার যে কারণে পদত্যাগ করতে বলেছেন, ওই কারণগুলোর যদি আমি উন্নতি করে দিতে পারি, তাহলে তো আর কোনো পদত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। তারা তো চাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হোক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন উন্নতি হয়, আমি সেই ব্যবস্থা করছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে এবং এর আরও উন্নতি হতে থাকবে।'
দেশে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করছে। গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা বলেন, 'শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টা যখন দায়িত্ব নেন, সবার আগে তাদের নারীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা উচিত ছিল। যেভাবে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তারা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তারা বলছেন, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কী বলবেন তাদের উদ্দেশ্যে?'
জবাবে উপদেষ্টা বলেছেন, 'মা-বোনদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তাদের ব্যাপারে সরকার সবসময় সচেতন এবং তাদের কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে না হয়, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সবসময় সজাগ আছে।'
এতসব ক্ষেত্র থেকে সজাগ থাকার পরেও চারিদিক থেকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানির খবর আসছেই। সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে অনবরত ধর্ষণের নানা খবর আসছে। ২ বছরের কন্যা থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী কেউ বাদ যাচ্ছেন না। পাশাপাশি গণপিটুনির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গণধর্ষণ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এরমধ্যে ১৮টি গণধর্ষণের। ২০২৪ সালে ঘটেছে ৪০১টি ধর্ষণের ঘটনা, এরমধ্যে ১০৫টা গণধর্ষণ। এখানে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া অনেক ঘটনাই থেকে যায় সংবাদের বাইরে। তাহলে উপদেষ্টা মহোদয়ের আশ্বাসের ওপর মানুষ আস্থা রাখবে কীভাবে?
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং এই সুযোগে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উপদেষ্টা স্যার গভীর রাতে প্রেস কনফারেন্স করলেও প্রকাশ্য দিবালোকেই ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ চলছেই।
বিভিন্ন এলাকায় চাপাতি ও রামদা হাতে দৌড়ানোর দৃশ্য এখন প্রতিদিন চোখে পড়ছে ও ভাইরাল হচ্ছে। বিশেষ করে, ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর মেয়েটি দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন, বা চাপাতি হাতে কয়েকজন দোকানে ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছেএন—এমন দৃশ্য দেখে মানুষ ভয় পাচ্ছে।
এসব অপরাধে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক ব্যবহার করছে ডাকাতেরা। পুলিশের ওপর হামলা, থানা থেকে অপরাধী ছাড়িয়ে নেওয়া, বিভিন্ন কাঠামো ভাংচুর, মবোক্রেসির উত্থান ও সরকারি অফিসগুলোতে হামলা চালানো খুব খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জানি না সরকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে এতোটা উদ্বেগহীন আছে কীভাবে? গত ২৪ সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, পরদিন অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আর কোনো অবনতি হতে তারা দেবেন না। কিন্তু তার দেওয়া কোনো কথাই ফলপ্রসূ হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়েছে সরকার, কিন্তু অবস্থা তথৈবচ।
এ সংকট কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন হবে। পেশাগত অপরাধীরা সবাই জেলহাজত থেকে বের হয়ে এসেছে, শক্তিশালী হয়েছে কিশোর গ্যাং এবং অন্যদিকে চলছে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক হানাহানি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সারাদেশে অনেক থানায় যে হামলা ও অস্ত্র, গোলাবারুদ লুট হয়েছে, সেগুলোর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সেসব আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে। ফলে দেশব্যাপী অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। অপরাধীরাও মুক্ত হয়ে ঘুরছে। এরা নিশ্চয়ই দেশ সেবা করার জন্য বের হয়নি?
মধ্যরাতে প্রেস কনফারেন্স করে আলোচনায় এলেও জননিরাপত্তা বিধান করা খুব কঠিন কাজ। আইন মানাতে হলে কাজ করতে হবে শক্ত হাতে। জুবুথুবু কাজ কোনো ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না, মিছাই হাসাহাসির সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে গভীর রাতে প্রেস কনফারেন্স করা দেখে দুষ্টু মানুষরা মন্তব্য করছেন, স্যার বোধকরি আমেরিকান টাইম মাথায় রেখে দেশে এই প্রথমবার প্রেস ব্রিফিং করলেন।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।