Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Saturday
May 17, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
SATURDAY, MAY 17, 2025
মুজিব: বন্দিজীবনের রোজনামচার আলোকে 

মতামত

মোরশেদ শফিউল হাসান
15 August, 2021, 12:55 pm
Last modified: 15 August, 2021, 01:57 pm

Related News

  • তিশা কেন বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে অভিনয় করেছেন, সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন: ফারুকী 
  • মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ৭ মার্চ ভাষণের রেকর্ড
  • বঙ্গবন্ধু সেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের নাম পরিবর্তন
  • চট্টগ্রামে আবৃত্তিতে ‘বঙ্গবন্ধু’, মাঝপথে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ
  • ফরিদপুরে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি স্তম্ভ ভেঙে দিল বিক্ষুব্ধ জনতা

মুজিব: বন্দিজীবনের রোজনামচার আলোকে 

পূর্ব বাঙলার এক নিভৃত পল্লী থেকে উঠে এসে কিভাবে মুজিব বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন  করলেন, তা বুঝতে তাকে নিয়ে লেখা লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠার বইপত্রের চেয়ে তাঁর নিজের লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' বই দুটি আমাদের অধিক সাহায্য করবে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
মোরশেদ শফিউল হাসান
15 August, 2021, 12:55 pm
Last modified: 15 August, 2021, 01:57 pm

কারাজীবন নিয়ে লেখা বই (স্মৃতিকথা, দিনপঞ্জি বা চিঠিপত্রের সংকলন) বিশ্বের সব ভাষার সাহিত্যেরই এক মূল্যবান সম্পদ। কারাগার মানুষকে জীবনের ভিন্ন এক বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। দেহের চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ে বলেই হয়তো মন সেখানে অধিকতর সজাগ ও সক্রিয় হয়ে ওঠে, সবার না হলেও অন্তত কারো কারো। কারাগারের নিভৃতি মানুষকে গভীর ভাবনাচিন্তার, আত্মসমীক্ষার ও আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ করে দেয়। মৌলিক সাহিত্য যাঁরা সৃষ্টি করেন তাঁরা বন্দিজীবনকে একরকম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। স্বভাবগতভাবে যাঁরা লেখক তাঁরা তো ভেতরের তাগিদেই লেখেন; অন্যরাও, বিশেষ করে রাজনৈতিক কারণে যাঁদের কারাভোগ করতে হয়, হয়তো বন্দিজীবনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিংবা কর্মহীন মুহূর্তগুলো ফলবান করে তুলতে হাতে কলম তুলে নেন। কখনো স্রেফ রচনার গুণে কিংবা জীবনাভিজ্ঞতার মূল্যে আবার কখনো তথ্য-বিশ্লেষণের গুরুত্বে সে সব লেখা কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়। জহরলাল নেহেরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া ও গ্লিম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি তেমনই দুটি বই। তাঁর এ দুটি বিখ্যাত বই এবং আত্মকথা (টুওয়ার্ড ফ্রিডম) তিনি জেলখানাতে বসেই লিখেছিলেন। তাঁর বহুলপঠিত লেটারস ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার-এ বালিকা ইন্দিরাকে লেখা যে-ত্রিশটি চিঠি সংকলিত হয়েছে সেগুলোও জেলখানায় বসে লেখা গ্লিম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রিরই অংশ। দফায় দফায় দীর্ঘ বন্দিজীবনই তাঁকে দিয়ে এ বইগুলো লিখিয়ে নিয়েছিল। না হলে এ সবগুলো বই তিনি লিখতে পারতেন কিনা সন্দেহ। উপমহাদেশের আরেক বিখ্যাত রাজনীতিক মওলানা আবুল কালাম আজাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিচিত গ্রন্থ ঘুবার-এ খাতিরও জেলখানায় বসে লেখা কতগুলো চিঠির সংকলন। ফাঁসির আদেশ পাওয়ার পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর জেলখানায় বসে লেখা জবানবন্দিটিও (ইফ আই অ্যাম এসাসিনেটেড) পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্র ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বোঝার জন্য একটি সহায়ক পুস্তক বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলা অনুবাদে চেক বিপ্লবী জুলিয়াস ফুচিকের ফাঁসির মঞ্চ থেকে বইটি একদা এদেশের সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে একটি অবশ্যপাঠ্য পুস্তক বলে বিবেচিত হতো। সেটিও ছিল জেলখানা থেকে গোপনে পাচার করা ও সিগারেট পেপারে লেখা কতগুলো প্রতিবেদনের সংকলন। আর ইতালীয় বিপ্লবী আন্তনিও গ্রামসির কারাবন্দি অবস্থায়  লেখা তিন হাজার পৃষ্ঠার রচনা সংকলন প্রিজন নোটবুকস তো আজ বিশ্বব্যাপী সমাজ-ইতিহাস ও রাজনীতি বিশ্লেষণের মার্কসীয় ধারায় এক মৌলিক ও যুগান্তকারী সংযোজন বলে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দক্ষিণ আফিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত ও বহুপঠিত আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডমও রুবেন দ্বীপের নিঃসঙ্গ কারা প্রকোষ্ঠে বসে লেখা।   

বাংলা ভাষায় স্বদেশী বিপ্লবীদের অনেকে তাঁদের বিপ্লবী জীবনের ঘটনাবলি নিয়ে যেমন, তেমনি কারাবন্দি বা দ্বীপান্তর জীবনের  স্মৃতি নিয়েও বই লিখেছেন (অনেকের রচনায় দুই অভিজ্ঞতা মিলেমিশে গেছে)। নামোল্লেখ করতে গেলে তালিকাটা বেশ দীর্ঘ হবে। পাকিস্তান আমলের কারাবন্দি জীবনের স্মৃতি নিয়েও কয়েকজন বই লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নামোল্লেখ করতে হয় তিনি ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ)। তাঁর জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৯৬৮) বইটি পাকিস্তান সরকার সে সময় নিষিদ্ধ করেছিল। এ বইটির এক বড় অংশ জুড়ে আছে অবশ্য লেখকের ব্রিটিশ আমলের কারান্তরীণ জীবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর  আগে পরে ১৯৬০ এর দশকেই কারাজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও যাঁরা স্মৃতিকথা বা রোজনামচা জাতীয় বই লিখেছেন তাঁরা হলেন শহীদুল্লা কায়সার (রাজবন্দীর রোজনামচা), সত্যেন সেন (রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ), মওলভি ফরিদ আহমদ (কারাগারে সাতাশ দিন)  জিতেন ঘোষ (জেল থেকে জেলে ও গরাদের আড়াল থেকে), আবদুস শহীদ (কারাস্মৃতি), শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (নিত্য  কারাগারে) প্রমুখ। এঁদের সবার বা উল্লিখিত সককটি বই-ই যে স্বাধীনতার আগে প্রকাশিত হয়েছে তা নয়। কয়েকটি বই সত্তর  দশকের গোড়ায়ও বেরিয়েছে। তবে পূর্বোল্লিখিত লেখকদের বইগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা বইটির একটি বড় পার্থক্য হলো, ওই বইগুলোর সবই প্রকাশিত হয় লেখকদের জীবদ্দশায়। আর সমসময়ে রচিত হলেও, মুজিবের বইটি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর চার দশকেরও বেশি সময় পর, ২০১৭ সালে। কারাগারে বসে মুজিব যে আত্মজীবনী লিখেছিলেন, দিনপঞ্জি লিখতেন, সে তথ্যটাই তাঁর পরিবারের বাইরে বিশেষ কেউ অনেকদিন পর্যন্ত জানতেন না। কিংবা জানলেও তাঁরা তা প্রকাশ করেননি। 

পূর্ব বাঙলার এক নিভৃত পল্লী থেকে উঠে এসে কিভাবে মুজিব বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করলেন, তা বুঝতে তাঁকে নিয়ে লেখা লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠার বইপত্রের চেয়ে তাঁর নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বই দুটি আমাদের অধিক সাহায্য করবে, একথা একরকম নির্দ্বিধায় বলা যায়। একটি জাতির হয়ে ওঠার ইতিহাসের পথরেখা অনুসরণ করতেও সাহায্য করবে আমাদেরকে যেমন ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী তেমনি তাঁর এই বন্দিজীবনের দিনলিপিটিও। উদ্ধৃতিবহুল এই রচনাটি মূলত সেই অনুসন্ধান ও উপলব্ধির প্রচেষ্টা থেকে।  

১৯৬৬ সালের ৮ মে ছয় দফার পক্ষে নারায়ণগঞ্জে পাটকল শ্রমিকদের এক জনসভায় বক্তৃতা করার পর মুজিবকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। তারপর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি একটানা বন্দি অবস্থায়ই কাটিয়েছেন। প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং পরে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে কুর্মিটোলা সেনানিবাসের একটি কক্ষে। রোজনামচার  লেখাগুলো সে সময়ই লিখিত, অনেকগুলো পাতা তারিখসহ ও শেষের কিছু পাতা তারিখবিহীনভাবে। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লেখা সংকলিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বইয়ের গোড়ায় আরেকটি খাতার লেখাও সংযোজিত হয়েছে, যা আইয়ুবি সামরিক শাসনামলের রচনা। জেলখানার ভেতরের অবস্থা ও বন্দিদের জীবনযাপন নিয়ে লেখা এ খাতাটির মুজিব নিজেই একটি নামকরণ করেছিলেন : 'থালা বাটি কম্বল / জেলখানার সম্বল'। বন্দি অবস্থায় বেগম মুজিবের স্বামীকে লেখালেখি করার জন্য খাতাগুলো দিয়ে আসা এবং মুক্তি পাওয়ার পর তা সংগ্রহ করা, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর অধিকৃত বাংলাদেশে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে একবার এবং পরেরবার ১৯৮২ সালে খাতাগুলো উদ্ধার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা, সর্বশেষ গ্রন্থাকারে প্রকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে দরকারি তথ্যগুলো মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর লেখা ভূমিকায় জানিয়েছেন।  গ্রন্থের প্রবেশক হিসেবে সেই তথ্যগুলোও পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

২ 
কারাগার যে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগত, বাইরের লোকের পক্ষে তা অনুমান করা কঠিন তো বটেই, এমনকি বেশিদিন জেলে না থাকলে কারো পক্ষে তা বোঝাও সম্ভব নয়। মুজিব একজন কারাবন্দির অভিজ্ঞতা থেকে দীর্ঘদিন সেই জেলজীবনকে প্রত্যক্ষ  করেছেন। সেটা হয়তো অনেকেই করেন, আর তাঁদের স্মৃতিকথায়ও কমবেশি সে অভিজ্ঞতা ঠাঁই পায়। কিন্তু মুজিবের বিবরণীটিকে যা অনন্যতা দিয়েছে তা হলো তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি ও সংবেদনশীল মন। বলা যায় গবেষকের নিষ্ঠা নিয়েই তিনি জেলখানার পরিবেশ ও তার বাসিন্দাদের জীবনের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর গভীর দরদ দিয়ে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। গোড়াতেই তিনি লিখেছেন,  "রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনে কি ঘটেছে তা লিখতে চাই না, তবে জেলে কয়েদিরা কিভাবে তাদের দিন কাটায়, সেইটাই আলোচনা করব।" (পৃ.২৭) তাঁর মতে, 'জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে'। সেই সব ছোট ছোট জেলের অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা পাওয়া যায় লেখাটিতে। আবার জেলখানায় চালু বিভিন্ন শব্দ বা কয়েদিদের ব্যবহৃত 'নিজস্ব  ভাষা'র পেছনেও রয়েছে মজার মজার সব ইতিহাস বা গল্প। যেমন একটি শব্দ 'কেসটাকোল', যার অর্থ কেসটেবিল। আর  'সিকম্যান' মানে হাসপাতাল। আবার কয়েদিদের কাজ বা দায়িত্ব অনুযায়ী তাদেরকে নানা দফায় ভাগ করা হয়। যেমন : 'রাইটার  দফা', 'চৌকি দফা', 'জলভরি দফা', 'ঝাড়– দফা', 'বন্দুক দফা', 'পাগল দফা', 'আইন দফা', 'ডালচাকি দফা' ইত্যাদি। 'পাগল দফা'র বর্ণনা দিতে গিয়ে মুজিব লিখেছেন, "দুনিয়ায় কত রকমের পাগল আছে জেলে আসলে বোঝা যায়। আমার কপাল ভাল কি মন্দ বলতে পারি না। তবে যেখানে পাগলদের রাখা হয় তার কাছেই আমাকে রাখা হয়েছিল।" (পৃ.৩৩) ফলে খুব কাছ থেকে পাগলদের জীবন, তাদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে। জেলের কয়েদিদের মধ্যেও বিশেষ করে পাগলদের জন্য তাঁর গভীর সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, "কতকাল যে ওরা এভাবে পড়ে আছে আর কতকাল থাকবে কে জানে! ... একবার জেলে এলে খুব কম লোকই ভাল হয়েছে। দুই একজন ভাল হলেও তাদের ছাড়তে এত দেরি করে ফেলে যে- আবারও পাগল হয়ে যায়।" (পৃ.৬৪) জেলখানার বন্দি পাগলদের এই দুর্দশায় বিচলিত হয়েই হয়তো তিনি, যদিও কিছুটা রসিকতার সুরে বলেছেন, "একবার জেলের গল্প করতে করতে আমার একমাত্র সহধর্মিণীকে বলেছিলাম. 'যদি কোনোদিন পাগল হয়ে যাই তবে পাগলা গারদে বা জেলের পাগলখানায় আমাকে দিও না।" (পৃ.৬৪) কারাবন্দি অবস্থায় পাগলদের চিৎকার- চেঁচামেচিতে রাতের পর রাত ঘুমের ব্যাঘাত হলেও তিনি তাদের ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেন না। বরং এক পাগলের কণ্ঠে কুকুরের ডাক শুনে 'মশারির ভেতর থেকেই হেসে ওঠা'র কথা লিখেছেন তিনি। ভেবেছেন, "একজন পাগল সত্য সত্যই একদম কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে পারে।" (পৃ.১৭৪)  

ব্রিটিশদের প্রবর্তিত জেলকোড অনুযায়ীই পাকিস্তান আমলে এবং সম্ভবত এখনও আমাদের জেলখানাগুলো পরিচালিত হয়। তবে ব্রিটিশ সরকার রাজবন্দিদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দিত, পাকিস্তান হওয়ার পর তা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৫০ দশকের গোড়ায় অবশ্য রাজবন্দিরা একটানা দীর্ঘদিন অনশন ধর্মঘট করে কিছু সুবিধা আদায় করে নেন। কিন্তু ব্রিটিশদের দেওয়া সে মর্যাদা আর পাওয়া যায়নি। মুজিব লিখেছেন, "ইংরেজ আমলে খাবার ও থাকার বন্দোবস্ত অনেক ভাল ছিল। এমনকি ফ্যামিলি এলাউন্সও দেওয়া হতো। মাসে টাকা বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতো সরকার।" (পৃ.৩৯) জেলখানার নানা দুর্নীতি যেমন অসুস্থ না হয়েও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া,  ডাক্তারদের ঘুষ খাওয়া, হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রি করা, কয়েদিদের খাবারে ভাগ বসানো ইত্যাদির কথাও মুজিব -কিছু কিছু প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজ কারাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আর কিছু কিছু কয়েদি ও জেলকর্মচারীদের কাছ থেকে জেনে- লিখেছেন। আমরা জানি, আজও সে বাস্তবতার অবসান হয়নি, টাকা খরচ করতে পারলে জেলে বসেই অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। চুরির দায়ে দীর্ঘদিন জেলখাটা লুদু নামক একজন পুরনো কয়েদির মুখে শুনে তার অপরাধ জীবনের যে কাহিনি মুজিব লিখে রেখেছিলেন, তা পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন, আমাদের জেলখানাগুলো এবং সেইসঙ্গে আইন, প্রশাসন এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজব্যবস্থা কিভাবে ছিঁচকে চোরকে বড় অপরাধীতে পরিণত করে। এ প্রসঙ্গে মুজিবের নিজের মন্তব্য : "জেল দিয়ে লোকের চরিত্র ভালো হয়েছে বলে আমি জানি না।" (পৃ.৪৬) ডাকাতি মামলার আসামি এক কয়েদির কথা তিনি লিখেছেন, ডাকাতি না করেও যে মামলার আসামি হয়েছে, তারপর মামলার খরচ যোগাতে গিয়ে তিন-তিনটা ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে। (পৃ.৯০) ছোটন নামে ডাকাতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আরেক কয়েদির কথা মুজিব লিখেছেন, একটি মামলাতেই যার ৫৩ বছর জেল হয়েছে, যার মধ্যে সাজা খাটতে হবে কমপক্ষে ২৫ বছর। এছাড়াও তার নামে রয়েছে আরও ১৯৩টি কেস। জীবনটা হয়তো তার জেলেই কেটে যাবে, কখনো স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে থাকা হবে না। বাইরে গেলেও তার উপায় নেই। দাগির খাতায় নাম উঠেছে, জড়িত থাকুক আর না থাকুক, ডাকাতি হলেই পুলিশ তাকে ধরে আনবে। মুজিব লিখেছেন, "অনেকে বিশ বৎসর জেল খেটে বের হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে যেয়ে বেশিদিন বাঁচে না। এখানে বেশিদিন থাকলে ভিতরে কিছুই থাকে না, শুধু থাকে মানুষের রূপটা। (পৃ.১৭৫) অনেক কয়েদির বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল কারাভোগের বিষয়টি উল্লেখ করে লিখেছেন, "এই জেলে অনেক লোক আছে যারা দুই তিন বৎসর হাজতে পড়ে আছে সামান্য কোনো অপরাধের জন্য। যদি বিচার হয় তবে ৬ মাসের বেশি সেই ধারায় জেল হতে পারে না। বিচারের নামে এ কি অবিচার!"  (পৃ.১৩৬) অর্ধ শতাব্দী আগে 'কারাগারের ইটের ঘরে গিয়ে' তাঁর প্রত্যক্ষ করা সেই অবিচারের অবসান কি আজও হয়েছে?

৩ 
মুজিব তাঁর রোজনামচা লিখতে আরম্ভ করেন ১৯৬৬ সালের ২ জুন। অর্থাৎ ছয় দফা আন্দোলনে তাঁর জেলজীবন শুরুর চব্বিশ দিন পর থেকে। ৭ জুনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আগেপরে তাঁর দলের ওপর সরকারের কঠোর দমননীতি, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেলভর্তি করা, ৭ জুন হরতালের দিন জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও তাতে হতাহতের ঘটনা- এসব নিয়ে মুজিবের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের প্রকাশ স্বভাবতই ঘটেছে তাঁর প্রথমদিকের এই দিনলিপিগুলোতে। ৭ জুনের আগের দিনের লেখা রোজনামচায় তিনি পরদিনের ধর্মঘট নিয়ে আশাবাদ ও উৎকণ্ঠা দুইই ব্যক্ত করেছেন। রোজনামচা লেখা শুরুই করেছেন তিনি বিরোধীদের ওপর সরকারের নিবর্তনমূলক আচরণের সমালোচনা দিয়ে :"সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহিরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে  এসেছে, ৭ জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য। অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে  গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কেন! পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে।" (পৃ.৫৫) পরদিন অনেক দেরিতে, বিকেল তিনটায়, যদি বা খবরের কাগজ পেলেন, অর্ধেক কালি দিয়ে ঢাকা। এ সম্পর্কে মুজিব তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লিখছেন, "পড়ার উপায় নাই। যারা যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের নামও ঢেকে দিয়েছে। শুধু ইত্তেফাক নয়, আজাদ ও পাকিস্তান অবজারভার কাগজেও কালি দিয়ে দিয়েছে ...।" (পৃ.৫৯) এর আগে সরদার ফজলুল করিম ও আরও কারো লেখায় খবরের কাগজে 'জানালা' তৈরির কথা আমরা পড়েছি। ১৯৬০ এর দশকে এসে বোধহয় কাঁচি কাটার পরিবর্তে কালি লেপার ব্যবস্থা হয়। তবে পত্রিকায় ধর্মঘটের কোনো খবর না থাকলেও, সে খবরহীনতা ও সরকারি প্রেসনোট থেকে তিনি ঠিকই অনুমান করতে পেরেছেন, বাইরে কী ঘটছে। (পৃ.৭১-৭২) আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য বাইরে নির্যাতিত বা আহত হয়ে যেসব কর্মী জেলে এসেছিল, তাদের অবস্থা দেখে মুজিব বিচলিত হয়েছেন। তিনি বিশেষ করে তাদের কথা ভেবেছেন যাদের বয়স অল্প এবং যারা হয়তো প্রথমবারের মতো জেলে এসেছে। (পৃ.৭১)  

জাতীয় পরিষদে 'সরকারি গোপন তথ্য আইন সংশোধনী বিল' আনা এবং সংবাদপত্রের ওপর অঘোষিত সেন্সরশিপ আরোপের ঘটনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে মুজিব এ সময় লিখেছেন:

ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোনো সংবাদ ছাপাতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে আরও হুকুম দিয়েছিল, 'এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করেছে এটা লিখতে পারবা না। ছাত্রদের কোনো নিউজ ছাপাতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারবা না।' ইত্তেফাকের উপর এই হুকুম দিয়েছিল। এটাই হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। আমরা তো লজ্জায় মরে যাই। দুনিয়া বোধহয় হাসে আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেখে।  

এভাবে সংবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার ফল যে কারো জন্যই শুভকর হতে পারে না, এবং দেশের রাজনীতিকে তা সন্ত্রাসবাদের পথে নিয়ে যেতে পারে, সে আশঙ্কা ব্যক্ত করে লিখেছেন:

... সরকারের এই নির্যাতনমূলক পন্থার জন্য এদেশের রাজনীতি 'মাটির তলে' চলে যাবে। আমরা যারা গণতন্ত্রের পথে দেশের মঙ্গল করতে চাই, আমাদের পথ বন্ধ হতে চলেছে। এর ফল যে দেশের পক্ষে কি অশুভ হবে তা ভাবলেও শিহরিয়া উঠতে হয়। কথায়  আছে, 'অন্যের জন্য গর্ত করলে, নিজেই সে গর্তে পড়ে মরতে হয়'। (পৃ.৬২) 

মুজিব আরও লিখেছেন, সরকার যখন খবরের পথ বন্ধ করে তখন দেশে গুজব বা রটনার পথ খুলে যায়। আর এতে "সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয় না।" (পৃ.৭৯) সব দেশের সব আমলের সরকার বা শাসন কর্তৃপক্ষেরই বোধহয় কথাটা মনে রাখা দরকার। 

সরকারের তরফে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথে মোকাবেলা করার ঔচিত্যের ওপর যেমন জোর দিয়েছেন, (পৃ.৬৫)  তেমনি পত্রিকাগুলোর কাছেও- মত বা দৃষ্টিভঙ্গির তফাত সত্ত্বেও- খবর প্রকাশে সততা দাবি করেছেন তিনি। আর এ ব্যাপারে  দৈনিক আজাদ-এর (ও কতক পরিমাণে পাকিস্তান অবজারভার-এরও) ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। (পৃ.৬৬ ও ৭১) বস্তুতপক্ষে সম্পাদকীয় নীতির দিক থেকে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী এবং সংস্কৃতিসহ নানা প্রশ্নে বিপরীত অবস্থানে থেকেও, ভাষা আন্দোলন হতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পর্যায়ে আজাদ সংবাদ পরিবেশনে তুলনামূলক সততা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। রোজনামচায় মুজিব পত্রিকাটির এই ঐতিহাসিক ভূমিকার স্বীকতি দিয়েছেন। এ যাবত আমাদের রাজনীতিক বা বুদ্ধিজীবী আর কেউ এই স্বীকৃতিটুকু দিয়েছেন কিনা, কিংবা আমাদের সংবাদপত্র বা সংবাদিকতার ইতিহাসে বিষয়টি সেভাবে উল্লেখিত হয়েছে কিনা, জানা নেই।  

তাঁর অনুপস্থিতিতে এবং সরকারের কঠোর দমননীতির মুখে ৬ দফার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া নিয়ে একরকম সংশয় বা উদ্বেগেরও যেন পরিচয় পাওয়া যায় রোজনামচার এ সময়কার লেখাগুলোতে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত নূরুল আমীনের বিবৃতি, যাতে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা ও তাঁদের মুক্তি দাবি করেন, তারও উল্লেখ করেছেন মুজিব। ৭ জুনের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, "সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার।" (পৃ.৭০) পরদিনও লিখেছেন, "সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম।" (পৃ.৭৪) ৭ জুনের আগের ও পরের কয়েকদিনের সরকারি নির্যাতনের যে বিবরণ তিনি জেলখানায়  বসে দিয়েছেন, তার চেয়ে অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণ আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। সেদিক থেকে ইতিহাসের উপকরণ হিসেবেও এই লেখাগুলোর একটা বিশেষ মূল্য বা গুরুত্ব আছে, গবেষকদের যা কাজে লাগবে। ধর্মঘটী জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে  হতাহতের প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য : "জীবন ভরে একই কথা শুনিয়াছি 'আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশ গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়'।" (পৃ.৭৩) 

স্বাধীন দেশে আজও কি আমরা ঘুরেফিরে একই কথা শুনি না? একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের ব্যাপারে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অত্যুৎসাহ বা বাড়াবাড়িরও মুজিব সমালোচনা করেছেন। (পৃ.৭৩ ও ১২৭) ভবিষ্যতে তাদের বিচার ও কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা বলতে গিয়েও লিখেছেন, "ক্ষমতায় গেলে এরাই সবার পূর্বে এসে আনুগত্য জানাবে এবং প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে।" (পৃ.১১৫)  

বস্তুতপক্ষে ৭ জুনের সফল হরতালের পর তিনি উপলব্ধি করেন যে ছয় দফা আর একা তাঁর নিজের বা দলের কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ নেই। পূর্ব বাঙলার মানুষ একে তাদের প্রাণের ও বাঁচার দাবি হিসেবেই গ্রহণ করেছে। চাইলেও তিনি এর থেকে পিছু হটতে বা এ ব্যাপারে কোনো আপোস করতে পারবেন না। পরবর্তী দিনগুলোতে হয়তো এই উপলব্ধিই তাঁকে চালিত করেছে।

৪ 
পাকিস্তানি শাসকরা যে দেশের পূর্বাঞ্চলটিকে আসলে তাদের কলোনি বা উপনিবেশ ছাড়া আর কিছু মনে করে না, এ ব্যাপারে মুজিবের ধারণা ছিল খুব স্পষ্ট। রোজনামচায় একাধিকবার তিনি তাঁর এই ধারণা বা মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ করতে গিয়ে ওই প্রস্তাবই যে তাঁর ছয়দফার ভিত্তি সে কথা জানিয়ে লিখেছেন, "কিন্তু লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র না করার জন্য দুই পাকিস্তানে ভুল বোঝাবুঝি চলছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে।" (পৃ.২১৪) আইয়ুব খানের পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসা প্রসঙ্গে লিখেছেন, "দেখে মনে হয় তিনি বাদশা হয়ে প্রজাদের দেখতে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তান তাঁর দেশ আর পূর্ব বাংলা তাঁর কলোনি।" (পৃ.২১৫) প্রশ্ন তুলেছেন, "যদি এক দেশই হবে তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসলেই তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এই অভ্যর্থনার প্রহসন কেন?" (পৃ.১৯২)  আজ স্বাধীন দেশেও অভ্যর্থনার এই ট্রাডিশন কি আমরা বদলাতে পেরেছি? অভ্যর্থনার বাড়াবাড়ির পেছনে মোনায়েম খানের প্রভু- 
তোষণ মনোবৃত্তির ভূমিকা শনাক্ত করে যদিও লিখেছেন, "আইয়ুব সাহেব সবই বোঝেন। ...আশা করি তিনি নিজে ভাল করে বুঝে নেবেন অবস্থাটা।" তবে এর পরপরই তাঁর মন্তব্য: "তবে আমার নিজের মতে মোনেম খান তার [আইয়ুবের- মোশহা] অনুমতি না  নিয়ে কিছুই করেন না।" (পৃ.১৯২)  

করাচির পর প্রথমে রাওয়ালপিন্ডি ও পরে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের রাজধানী নির্মাণের তিনি সমালোচনা করেছেন। রোজনামচায় একাধিকবার তিনি বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, রাজধানী বদল করার জন্য টাকার অভাব হয় না, পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য টাকার অভাব। (পৃ.১১১) একে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি নমুনা হিসেবে দেখেছেন। ঢাকায় দ্বিতীয় বা 'উপরাজধানী' করার উদ্যোগটিকে তাঁর মনে হয়েছে 'পূর্ব বাঙলাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য' একরকম  'প্রোপাগান্ডা'। (পৃ.১১১) পল্টনে স্বায়ত্তশাসন বা ছয়দফা দাবির সপক্ষে বক্তৃতার অপরাধে তাঁর বিচার প্রসঙ্গেও লিখেছেন, "আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমার বুকে ব্যথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে ন! আমার সম্পদ ছলে বলে কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তো দূরের  কথা- বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি ঐকন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।" (পৃ.২১৭)   

পাকিস্তানি শাসকদের আচরণ, দেশটির গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করে মুজিব তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন, "পাকিস্তানের ১৯ বৎসরে যা দেখলাম তা ভাবতেও শিহরিয়া উঠতে হয়। যেই ক্ষমতায় আসে সেই মনে করে সে একলাই দেশের কথা চিন্তা করে, আর সকলেই দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী আরও কত কি! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রেখে অনেক দেশনেতাকে শেষ করে দিয়েছে। তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে, সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কতকাল এই অত্যাচার চলবে কে জানে! এই তো স্বাধীনতা, এই তো মানবাধিকার।" (পৃ.১৮৪) একনায়কতান্ত্রিক সরকার ও রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক চরিত্র সম্পর্কে তাঁর এ পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি আজও পৃথিবীর অনেক দেশের বেলায়ই সত্য।

কারাগারে রাজনৈতিক বন্দিদের কষ্টের মধ্যে রেখে তাঁদের মনোবল ভাঙার এবং তাঁদেরকে আদর্শচ্যুত করার সরকারি প্রচেষ্টার উল্লেখ করে মুজিব লিখেছেন, "নীতির জন্য, আদর্শের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য যারা ছেলেমেয়ে সংসার ত্যাগ করে কারাগারে থাকতে পারে, যে কোনো কষ্ট স্বীকার করবার জন্য তারা প্রস্তুত হয়েই এসেছে।" (পৃ.২২১) 

৫

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাঁর বিশ্বাসের কথা মুজিব তাঁর রোজনামচার নানা জায়গায় নানাভাবে বলেছেন। যেমন ২৭ জুলাই ১৯৬৬ তারিখে লিখেছেন, "আমি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। যদি ঐ পথে কাজ করতে না পারি ছেড়ে দিব রাজনীতি।" পরের  কথাগুলো হয়তো তাঁর একরকম অভিমানবোধ থেকেই বলা : "প্রয়োজন কি! আমরা একলা দেশসেবার মনোপলি নেই নাই। ... বহুদিন রাজনীতি করলাম। এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে আরাম করব।" যদিও সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন, "তবে সরকার যেভাবে জুলুম চালাচ্ছে তাতে রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেয় বোঝা কষ্টকর।" (পৃ.১৮২)   

বস্তুতপক্ষে মুজিব গণতন্ত্রের পথেই তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে, জনগণের দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। পূর্ব বাঙলার  স্বাধিকার অর্জনও সে পথেই সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। রোজনামচায় তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, সরকারি নির্যাতন নিস্পেষণের মুখে গণতান্ত্রিক আন্দোলন না বেপথু হয়, 'মাটির নিচে' চলে না যায় (বলা বাহুল্য আন্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন তৎপরতার অর্থে তিনি এই 'মাটির নিচে' কথাটা ব্যবহার করেছেন, পৃ.)! তিনি আশা করেছিলেন, পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পূর্ব বাঙলার মানুষও দেশটির শাসন ক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ পাবে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি হবার পর গণতান্ত্রিক পথে পূর্ব বাঙলার জনগণের অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত বা অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঢেকে গেল, তখন প্রায় দিশাহারা বা বেপরোয়া হয়েই তিনি একবার ভারতের সাহায্য নিয়ে পূর্ব বাঙলাকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কূটনৈতিক যোগাযোগ এবং তারপর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে কোনো কার্যকর সহায়তার আশ্বাস তিনি পাননি। তখনকার পরিস্থিতিতে ভারতের অসুবিধার কথাও নাকি নির্দিষ্ট চ্যানেলে নেহেরু মুজিবকে জানিয়েছিলেন। ফলে হতাশ ও ব্যর্থ মনোরথ মুজিব দেশে ফিরে আসেন। এবং দেশে ফিরেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। এই অভিজ্ঞতাও হয়তো মুজিবকে একাত্তরের ২৫ মার্চের পর, অন্যদের যেতে বললেও, তাঁর নিজের ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার পেছনে কাজ করেছিল।  

সুতরাং আজ যাঁরা প্রমাণ করতে চান ১৯৬০ দশকের গোড়া থেকেই মুজিব ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা  শুরু করেন এবং সে উদ্দেশ্য নিয়ে অব্যাহতভাবে কাজ করে গেছেন, তাঁরা মনে হয় ঠিক কথা বলেন না। এ বিষয়ে শশাঙ্ক ব্যানার্জী নামক একজন ভারতীয় কূটনীতিকের বরাত দিয়ে সম্প্রতি কেউ কেউ যেসব কথা লিখছেন ও বলছেন, তার কোনো আভাস ইঙ্গিত দূরের কথা, সামান্যতম যৌক্তিক ভিত্তি ১৯৬৮ সাল অবধি লেখা তাঁর এই দিনলিপিতে পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় কে কবে কার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, কেবল স্মৃতির ওপর নির্ভর করে কী বলেছেন, ভালোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়া তা গ্রহণ করার কোনো যুক্তি নেই। তেমনি তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের দোহাই দিয়ে কোনো কথা বলাও ঠিক নয়।

আসলে মুজিব তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায় যেমন দেশের ভেতরে আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, এদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন; পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকের সঙ্গে তাঁর যেমন যোগাযোগ ছিল; প্রতিবেশী দেশ ভারতের (হয়তো অন্যান্য কোনো কোনো দেশেরও) কূটনীতিকদের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ রক্ষা করতেন। 

মুজিবকে যখন 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'য় বিচার করার উদ্দেশ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে এনে অন্তরীণ করে রাখা হয়, তখনও দেখা যায়, একেবারে শুরু থেকেই তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সেনা কর্মকর্তাদের গোপন বা ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তাঁর অনাস্থার কথা বারবার অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন। বলেছেন তিনি যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন  চান, এটা তো কোনো গোপন ব্যাপার নয়। ১৯৪৯ সাল থেকেই তিনি প্রকাশ্যে এ দাবি জানিয়ে আসছেন। পরিষদের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে কথা বলেছেন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা দেওয়ার পরও তা বই আকারে ছেপে বিলি করেছেন, সে দাবির পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছেন। যে-কারণে তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে, কতগুলো মামলাও দেওয়া হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এ-প্রসঙ্গে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কথাও বলেছেন, "সংখ্যাগুরু অঞ্চল সংখ্যালঘুদের ভয়ে আলাদা হতে পারে না। আর এমন কোনো নজির ইতিহাসে নেই।" (পৃ.২৬০) ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময় আদালতে তাঁর আনুষ্ঠানিক লিখিত জবানবন্দি দেওয়ারও আগে, অন্তরীণ অবস্থায় সেনা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাঠানো প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে লেখা চিঠিতেও তিনি খুব সম্ভব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাঁর এই বিশ্বাসের কথাই ব্যক্ত করেছিলেন।  

৬ 
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আকস্মিক মুক্তি দিয়ে তাঁকে ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করার জন্য কড়া সেনা প্রহরায় কুর্মিটোলা সেনা অফিসার মেসের একটি কক্ষে এনে তোলা হয়। শুরু হয় তাঁর আরেক, অন্যরকম বন্দিজীবন। সে নিঃসঙ্গ বন্দিজীবনের কয়েকটি দিনের অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা পাওয়া যায় কারাগারের রোজনামচা বইয়ের শেষাংশে সংযোজিত নোটখাতার কয়েকটি পাতায়। পড়ে শিউরে উঠতে হয়।  

সেদিন রাত ১২টার পর মুজিবকে যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখনও তাঁর নামে অনেকগুলো মামলা ঝুলছিল। এ অবস্থায় হঠাৎ এভাবে মাঝরাতে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারটি মুজিবকে যতটা না বিস্মিত তার চেয়ে বেশি সন্দিহান করে তোলে। কিছুদিন আগে সামরিক বাহিনীর সদস্য, উচ্চপদস্থ বেসামরিক আমলা ও সাধারণ নাগরিক মিলিয়ে বেশ কজন বাঙালিকে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের দায়ে গ্রেপ্তারের কথা তিনি জেনেছিলেন। তাঁকেও যে সে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হতে পারে,  জেলের ভেতরে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে এমন আভাসও তিনি পেয়েছিলেন। জেলগেট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর তাঁকে সেখানে অপেক্ষমাণ সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে নেওয়া এবং কড়া সামরিক প্রহরায় কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতের বেলা  নির্জন সড়ক দিয়ে যেতে যেতে তিনি অনেকদিন পর তাঁর অতিপরিচিত ঢাকা শহরকে দেখতে পেলেন। প্রায় সতের মাস আগে গ্রেপ্তার করার পর মামলার প্রয়োজনেও তাঁকে কখনো আদালতে আনা হয়নি। বিপজ্জনক আসামি বিবেচনায় জেলগেটেই বিশেষ আদালত বসিয়ে তাঁর মামলার শুনানি হয়েছে। রাতের ঢাকায় তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুজিব মনে মনে তাঁদেরকে সালাম জানিয়ে বলেন, "চিরনিদ্রায় শুয়ে আছ, একবারও কি মনে পড়ে না এই হতভাগা দেশবাসীদের কথা।" (পৃ.২৫৫)  

সেনানিবাসের যে বন্ধ ঘরটিতে তাঁকে রাখা হয় সেটি ছিল থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার মেসের গেস্টরুম। ঘরটার দরজা জানালার কাঁচগুলোও এমনভাবে রং করা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে কোনো আলো ঢুকতে না পারে। ফলে দিনরাত সবসময় সেখানে বাতি জ্বেলে রাখতে হতো। ঘরের দরজাতেই যে শুধু সশস্ত্র সেনা পাহারা ছিল তা নয়। একই কক্ষে তার পাশের বিছানায় একজন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যার কাজ হলো সর্বক্ষণ বন্দিকে চোখে চোখে রাখা যাতে তিনি পালাবার বা আত্মহত্যার চেষ্টা করতে না পারেন। তবে বন্দির সঙ্গে তার কথাবার্তা বলা নিষেধ। আশেপাশের কক্ষগুলোতে আর কোনো বন্দি আছে কিনা তা জানারও সুযোগ মুজিবের ছিল না। প্রথমদিকে অফিসার মেস থেকে দুবেলাই তাঁকে কেবল রুটি খেতে দেওয়া হতো। সঙ্গে মাংস ও/বা ডাল। পরে তাঁর অনুরোধে তাঁকে ভাত দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। রেডিও শোনার বা খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ ছিল না। লিখেছেন, "আমার কাছে দুইখানা মাত্র বই ছিল। অন্য বইগুলি জেলখানায় রেখে এসেছি। ভুল করেছি বই না এনে। অফিসার ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, বই পড়তে আপত্তি আছে কিনা। তিনি বললেন, বই দেওয়ার হুকুম আপাতত পাই নাই। তবে আপনার কাছে থাকলে পড়তে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে বাইরে যান। আমি যে কড়িকাঠ গুনবো সে ব্যবস্থাও নাই।  কারণ কড়িকাঠও দালানে নাই। আলো জ্বালানই ছিল। সুকর্ণর পতন সম্বন্ধে বই দু'টি পড়তে লাগলাম। কিন্তু মন বসছে না, নানা চিন্তা ঘিরে ধরছে। কি করব বসে বসে শুধু পাইপ খেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম রাজনীতি এত জঘন্য হতে পারে। আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে কারো বিবেকে দংশন করলো না। আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি। যাহা ভাল বুঝেছি তাই বলেছি। বক্তৃতা করে বেড়াইয়াছি, গোপন কিছুই করি না বা জানি না। সত্য কথা সোজাভাবে বলেছি তাই সোজাসুজি জেলে চলে গিয়াছি।" (পৃ.২৫৮) 

ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বন্দি অবস্থায় যা তাঁকে বেশি কষ্ট দিয়েছে তা হলো বাংলায় কথা বলতে ও বই পড়তে না পারা। এ  সম্পর্কে লিখেছেন, "থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কোনো বাঙালি কর্মচারী বা সিপাহি নাই। যে অফিসার মেসে আমাকে রাখা হয়েছে,  সেখানে একজন বয় আছে যার উপর হুকুম আছে আমাদের কাছে আসতে পারবে না। আর একজন লোককে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখি, মালি। তাই বাংলা কথা বলার উপায় নাই -পূর্ব বাংলার মাটিতে থেকেও- একেই বলে অদৃষ্ট! প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু' একখানা এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না। যে কয়েকজন অফিসার আছেন তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, তারাই আমার ডিউটি করতেন। বাঙালিদের বোধহয় ডিউটি দেওয়া নিষেধ ছিল। অন্য কোনো রেজিমেন্টে বাঙালি দুই একজন থাকলেও আমার কাছে আসার উপায় নাই।" (পৃ.২৬৭)  

কুর্মিটোলা সেনানিবাসে তাঁর সে বন্দিত্বের দিনগুলোতে সেনা অফিসাররা প্রায় সবাই তাঁর সঙ্গে মোটামুটি ভালো ব্যবহার  করেছেন। কিন্তু তারপরও তাঁদের সবার মধ্যে তিনি বাঙালিদের প্রতি অবিশ্বাস বা সন্দেহ লক্ষ করতেন। এ প্রসঙ্গে যা লিখেছেন তা  বেশ তাৎপর্যপূর্ণ:

একটা আশ্চর্য ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। এমনভাবে মাসের পর মাস এদের সাথে থাকার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। এখানে থাকবার সুযোগ পেয়ে দেখলাম বাঙালিদের তারা ব্যবহার করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিশ্বাস করতে রাজী নয়। আর বিশ্বাস করেও না।  সকলকেই সন্দেহ করে। তাদের ধারণা প্রায় সকলেই নাকি আমার ভক্ত। মনে মনে সকলেই নাকি আলাদা হতে চায়। পূর্ব বাংলায় বাঙালির মুখ দেখতে পারি নাই কয়েকমাস এ কথা কি কেহ বিশ্বাস করবে? পাঁচ মাসের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে পারি নাই। কারণ কেহই বাংলা জানে না। ঢাকা রেডিও এরা শোনে না। হয় কলম্বো, না হয় দিল্লী- হিন্দি উর্দু গান শোনার জন্য। বাংলা গান এরা বোঝে না বলেই শুনতে চায় না। বাংলা গান হলেই রেডিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।  

অর্থাৎ আপাতদৃষ্টে একই রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও, পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মানসিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানও ছিল বিরাট,  আর ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ তা এক অমোচনীয় বাস্তবতায় পৌঁছে গিয়েছিল। মুজিব তাঁর কারাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেও সেটা বুঝেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আর কেউ বোধহয় তাঁর মতো করে এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারেননি। বিপরীত দিক থেকে তিনিও বাঙালির বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতা স্পৃহার প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। 

(সংক্ষেপিত)


(মোরশেদ শফিউল হাসান: লেখক ও গবেষক )
 

Related Topics

টপ নিউজ

বঙ্গবন্ধু / জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান / ১৫ আগস্ট

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেনযাত্রা, কিন্তু শেষ করতে পারেনি কেউই 
  • উড্ডয়নের সময় খুলে পড়ে গেল বিমানের চাকা, ৭১ যাত্রী নিয়ে ঢাকায় নিরাপদে অবতরণ
  • ট্রাম্প বললেন কেউ পালায়নি, অথচ আলকাট্রাজ থেকে পালানো তিন বন্দির রহস্য এখনও অজানা!
  • ভারতে পারমাণবিক উপাদান ‘চুরির ঘটনায়’ আইএইএ-র তদন্ত চায় পাকিস্তান
  • মধ্যরাতে প্রায় ৭৫০ জনকে বাংলাদেশে পুশইনের চেষ্টা; খবর পেয়ে রুখে দিল বিজিবি-জনতা; রাতভর টহল
  • মধ্যপ্রাচ্যকে ট্রাম্পের অঙ্গীকার: 'কীভাবে জীবনযাপন' করবে এ নিয়ে আর লেকচার না

Related News

  • তিশা কেন বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে অভিনয় করেছেন, সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন: ফারুকী 
  • মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ৭ মার্চ ভাষণের রেকর্ড
  • বঙ্গবন্ধু সেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের নাম পরিবর্তন
  • চট্টগ্রামে আবৃত্তিতে ‘বঙ্গবন্ধু’, মাঝপথে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ
  • ফরিদপুরে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি স্তম্ভ ভেঙে দিল বিক্ষুব্ধ জনতা

Most Read

1
আন্তর্জাতিক

বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেনযাত্রা, কিন্তু শেষ করতে পারেনি কেউই 

2
বাংলাদেশ

উড্ডয়নের সময় খুলে পড়ে গেল বিমানের চাকা, ৭১ যাত্রী নিয়ে ঢাকায় নিরাপদে অবতরণ

3
আন্তর্জাতিক

ট্রাম্প বললেন কেউ পালায়নি, অথচ আলকাট্রাজ থেকে পালানো তিন বন্দির রহস্য এখনও অজানা!

4
আন্তর্জাতিক

ভারতে পারমাণবিক উপাদান ‘চুরির ঘটনায়’ আইএইএ-র তদন্ত চায় পাকিস্তান

5
বাংলাদেশ

মধ্যরাতে প্রায় ৭৫০ জনকে বাংলাদেশে পুশইনের চেষ্টা; খবর পেয়ে রুখে দিল বিজিবি-জনতা; রাতভর টহল

6
আন্তর্জাতিক

মধ্যপ্রাচ্যকে ট্রাম্পের অঙ্গীকার: 'কীভাবে জীবনযাপন' করবে এ নিয়ে আর লেকচার না

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net