মার্কিন জনতার জীবনকে চীনের হাতে সঁপে দিয়েছেন ট্রাম্প

মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক সামান্থা ভিনোগ্রাড। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া রোধে ট্রাম্প প্রশাসনের অদূরদর্শিতা এবং পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেছেন তিনি।
রোববার সিএনএনে প্রকাশিত এক রাজনৈতিক প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সাম্প্রতিককালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক এবং সেই আলোকে চীনের তৈরি চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতাকে 'মার্কিন জনতার জীবনকে চীনের হাতে সঁপে' দেওয়ার সঙ্গেই তুলনা করেন তিনি। ওই সম্পাদকীয় কলামের সংক্ষিপ্তসার নিচে তুলে ধরা হলো:
চীন এমন এক দেশ, হোয়াইট হাউস যাকে যুক্তরাষ্ট্রের 'কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী' হিসাবে চিহ্নিত করেছে। দেশটি বিশ্বজুড়ে আমাদের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে ব্যস্ত। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনকে একটি 'স্বৈরাচারী রাষ্ট্র' বলে অভিহিত করে, যে রাষ্ট্র তার নিজ দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।
দেশটি মার্কিন অর্থনীতির উন্মুক্ত অবস্থানের সুযোগ নিয়ে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে দাবি করে হোয়াইট হাউস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দেশটিকে 'মার্কিন জীবনযাত্রা' ধরে রাখার পথে একটি 'হুমকি' বলেও উল্লেখ করেছেন। এমনকি ওই দেশের বিরুদ্ধে খোদ ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা করোনাভাইরাস মহামারির তথ্য গোপন করার অভিযোগ তুলেছিলেন।
যে চীনের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, এখন তার অবস্থান কী? সত্য হলো, মার্কিন নাগরিকদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার চীনের ওপরই নির্ভর করছে।
অরুচিকর হলেও এটাই বাস্তবতা। যে বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্র এড়াতে পারত। আজ ভাগ্যের ফেরে যে দেশ মতান্তরে করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ি, সেটিই এখন এই বৈশ্বিক মহামারির মারণ ছোবল থেকে সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের অবস্থানে রয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনেক আগে থেকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিলেন, চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে তার নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র যখন বৈশ্বিক মহামারির নতুন ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে, ঠিক তখনই ট্রাম্পের প্রস্তুতিহীনতার সুবাদে চীনের সামনে আরও দ্রুত তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ উন্মোচিত হলো।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি। তারপরও দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল মহামারি মোকাবেলায় প্রায় নিষ্ক্রিয়। এর দায় ট্রাম্প প্রশাসনের।
করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে হানা দেওয়ার আগে থেকেই যদি তারা একটি দুর্যোগ পরিকল্পনা গ্রহণ করত, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ওষুধ মজুদ রাখত এবং তা সকল হাসপাতালে সঠিকভাবে পৌঁছে দিত, তাহলে আজ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অসংখ্য নাগরিকের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তার কোনোটাই এই প্রশাসন করেনি।
পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যুদ্ধকালীন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দিতে ট্রাম্পের গড়িমসির কারণে। অবশ্য শেষমেশ এক প্রকার বাধ্য হয়েই তিনি ডিফেন্স প্রোডাকশন্স আইনটি কার্যকর করে এর আওতায় স্থানীয় উৎপাদকদের যথেষ্ট পরিমাণে ভেন্টিলেটর এবং এন-৯৫ মাস্ক উৎপাদনের নির্দেশ দিয়েছেন।
উদাসিনতার আরও নজির রয়েছে। ৭ হাজার মার্কিনির মৃত্যুর পর গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের পরেও যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট পরিমাণ চিকিৎসা এবং সুরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন করতে পারছে না।
এর ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের পাশাপাশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের জীবন নিশ্চিত হুমকির মুখে পড়ছে। বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার কারণেই এখন জনগণ বাধ্য হয়ে যেখান থেকে পারছেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
শনিবার নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর আন্ড্রু কোমো জানান, চীন সরকার তার রাজ্যে এক হাজার ভেন্টিলেটর অনুদান দিয়েছে। এছাড়াও রাজ্যটি ইতোমধ্যেই চীন থেকে আরও ১৭ হাজার ভেন্টিলেটর আমদানি করছে। অনেক নাগরিক নিজ উদ্যোগে চীন থেকে জীবাণুরোধী এন-৯৫ মাস্ক আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন।
মার্কিন চাহিদার প্রেক্ষিতেই প্রসারিত হয়েছে চীনের চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবসা। দেশটির শীর্ষ এক চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী সকল হাসপাতালের চাহিদার কারণে তাদের পণ্য বিক্রি ১০ গুণ বেড়েছে।
চীন সরকারের দেওয়া নানা প্রকার বাণিজ্যিক তথ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও বর্তমান বাস্তবতায় তা মিথ্যে হওয়ার সুযোগ অনেকটা কম। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এখন ২১টির বেশি চীনা কোম্পানি বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ভেন্টিলেটর উৎপাদন করছে। আর বৈদেশিক বাজার থেকে ২০ হাজার নতুন ভেন্টিলেটর ক্রয়ের আদেশ এসেছে। এই গতিতে চীনের ব্যবসা আগামীদিনে যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
শুধু মুনাফা নয়, অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে চীন দেশে দেশে তার প্রভাব আরও বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছে। আগামী দিনে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলবে।