মাওয়ার স্পিডবোট গতিহীন, মালিক-শ্রমিকরা দুশ্চিন্তায়

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে পদ্মার দুই পারের কোটি মানুষ এখন উচ্ছ্বসিত। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাজিরকান্দি নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চ ও স্পিডবোটের চালক, মালিক কর্মচারীরার খুশি। তবে উদ্বোধনের দুইদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা আর হতাশা দেখা দিয়েছে।
সেতু চালু হওয়ায় নৌরুটে আর কোনো যাত্রী আসবে না। এতে নৌযান বন্ধ হয়ে পড়লে বহু বছরের জীবিকার কী হবে? মাথার ওপর এখন দুশ্চিন্তার মেঘ প্রমত্তা পদ্মায় যাত্রী পারাপারকারী এসব মানুষের।
শিমুলিয়া ঘাটে ১৫১টি স্পিডবোট ও ৮৭টি লঞ্চ চলাচল করে। মালিক ও শ্রমিক সব মিলিয়ে হাজারের মতো মানুষ এ পেশায় যুক্ত। পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহে তাদের দাবি সরকারি সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের। এবিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
স্পিডবোট মালিক তপু আহমেদ জানান, "পদ্মা সেতু চালু হয়েছে খুশি কিন্তু আমাদের কী হবে? গতকাল শুধু একটা ট্রিপ নিয়েছি। আজকে একটাও পাই নাই। স্পিডবোট চললে আমি আর আমার চালকরা দুইটা টাকা পাব। এখন যা চায় তা দিয়েই স্পিডবোট বিক্রি করে ফেলতে হবে। আট লাখ টাকা খরচ করে স্পিডবোট কিনছিলাম। এখন তো কেনার মতো মানুষই পাই না। মাঝখানে একজন ৫ লাখ টাকায় নিতে চেয়েছিল, দিলাম না। বিক্রি করা ভালো ছিল। কিস্তি নিয়ে স্পিডবীয়টা কিনেছিলাম। এখন প্রতি মাসে কিস্তি টানতে হয় ৮,১৬০ টাকা। আয়ই নাই, কিস্তির টাকা দিব কীভাবে।"
স্পিডবোট চালক বেলাল হোসেন বলেন, "আমার দুটি স্পিডবোট। একটি আমার নিজের, আরেকটি চার বন্ধু মিলে কিনেছি। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় হতো। শিমুলিয়া ঘাটে সিরিয়াল অনুযায়ী স্পিডবোট চলে। যাত্রী কম থাকায় কালকে সিরিয়াল পাইনি। আজকে পাব কি না সন্দেহ। স্পিডবোট আয়ের একটি অংশ চালকরা পায়। স্পিডবোট না চললে চালকরা কই থেকে টাকা পাবে। ঘাটে অনেকেই স্পিডবোট বিক্রি করে ফেলেছে, আবার সিলেটের জন্য ভাড়া দিচ্ছে। আমি যা পাই তাই দিয়েই আমারটা বিক্রি করে দিব।"
এমএল তপন লঞ্চের মালিক খোকন আহমেদ জানান, "পদ্মা সেতু চালু হয়েছে আমরা খুশি। আশেপাশের ঘাটের এলাকার লোকজনও খুশি। দীর্ঘদিন ধরে লঞ্চটা চলছে। শিমুলিয়া নৌরুটে ভালোই ছিলাম। লঞ্চের সাতজন কর্মচারী, তারাও ভালো ছিল। এখন পদ্মা সেতু চালু হয়েছে মাত্র দুই দিন। এরমধ্যেই যাত্রী নাই। ঘাট থেকে কাল মাত্র দশটার মতো লঞ্চ ছেড়ে গেছে। আজ অনেকটাই ফাঁকা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন বিকল্প নতুন রুট তৈরি করে এই লঞ্চকে সেই রুটে চলাচলের অনুমতি দেওয়া।"
এমএল ফাহিম-তামিম লঞ্চের মাস্টার জাহাঙ্গীর জানান, "গতকাল একটা ট্রিপ ছিল। আজ তো যাত্রীই নাই। বসে আছি, সিরিয়াল পাব কি না জানি না। মালিক জানে কী করব। লঞ্চ বিক্রি করব না কি অন্য লাইনে চালাবে। তবে আমাদের একটা কথা আছে। আমরা যারা লঞ্চের স্টাফ বা লঞ্চচালক তাদের লাইসেন্সে মাওয়া জোন লেখা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, এটা যদি সরিয়ে দেয় তাহলে আমরা অন্য জায়গায় লঞ্চ চালাতে পারব।"
স্পিডবোট চালক মো. রাসেল মিয়া জানান, "দুই দিনের চিত্র দেখে কী করব বুঝতেছি না। আল্লাহ যদি বাঁচায় রাখে সেটাই ভরসা।"

শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার মোহাম্মদ হাবিব জানান, আগে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৮০ থেকে ১০০টি স্পিডবোট ট্রিপ পাওয়া যেত। আজকে সকাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র দুটা স্পিডবোট ছেড়ে গেছে ঘাট থেকে। তাহলে বুঝেন স্পিডবোটের এ পেশায় থাকা কতটা মুশকিল।"
তিনি আরও বলেন, "এক বছরের জন্য গত জুন মাসে আড়াই কোটি টাকার ইজারা পাই বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ থেকে। বছর শেষ হয়নি, এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেল। তাই সরকারের কাছে আবেদন আমাদের দিকে তাকায় কিছু ক্ষতিপূরণ যেন দেওয়া হয়।"
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (লৌহজং) আব্দুল আওয়াল বলেন, "শুধু লঞ্চ চালক শ্রমিক বা স্পিডবোট চালক শ্রমিকই না। শিমুলিয়া ঘাটকেন্দ্রিক জীবিকার সঙ্গে জড়িত, এমন পাঁচ হাজার জনের নাম আমাদের ডেটাবেজে আছে। পদ্মা সেতু পুরোপুরি চালু হতে আরও ছয় মাস লেগে যাবে। আমরা যতটুকু জেনেছি ভারি যানবাহন নিচ দিয়ে চলাচল করবে। পদ্মাসেতু কেন্দ্রিক পর্যটন বাড়লে এসব লঞ্চ এবং স্পিডবোট ব্যবহৃত হতে পারে। সেক্ষেত্রে তা কর্মসংস্থানের যোগান দিবে।"
শিমুলিয়া নদী বন্দরের সহকারী বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা মোঃ শাহাদাত হোসেন বলেন, "নৌযান ও সংশ্লিষ্টদের পুনর্বাসনে বিআইডাব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চলছে বিকল্প অভ্যন্তরীণ নৌরুট খোঁজার কাজ। পাশাপাশি যাত্রী চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিমুলিয়া নদীবন্দরেও থাকবে ব্যবস্থা। বিআইডব্লিউটিএ'র নৌবন্দরের যেসব স্থাপনা রয়েছে যেমন চিলমারী বাহাদুর শাহ এবং ঢাকার অদূরে যেখানে লঞ্চ চলাচল করতে পারে সেসব জায়গায় লঞ্চ চলাচলের জন্য শিমুলিয়া লঞ্চ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিমুলিয়া লঞ্চ মালিক সমিতির লোকজনসহ আমরা বেশ কয়েক মাস আগেই বিভিন্ন নৌ বন্দরে ঘুরে এসেছি এবং লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করছি।"