সিলেটে আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের জন্য হাহাকার, হবিগঞ্জে বন্যার অবনতি

বন্যায় সিলেটের দুর্গকুমার পাঠশালায় আশ্রয় নিয়েছেন ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া। বৃহস্পতিবার এ আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন তিনি। শুক্রবার কিছু লোক এসে রান্না করা খাবার দিয়ে যান। এরপর আর কোনো সহায়তা পাননি লিটন।
তিনি বলেন, 'এক দিন কেবল খাবার পেয়েছিলাম। এরপর আর কিছু পাইনি। এখানে রান্নার সুযোগ নেই। খুব কষ্টে আছি। তবু তো উপোস থাকা যায় না। আমরা না হয় যেকোনো কিছু খেয়ে ফেললাম। বাচ্চারা তো বুঝতে চায় না। তাই পানি ডিঙিয়ে বাসায় গিয়ে রান্না করে এখানে খাবার নিয়ে আসি।' বাসায় পানি উঠলেও চুলা ডুবেনি বলে জানান তিনি।
একই এলাকার মোহাম্মদ আলীও উঠেছেন দুর্গাকুমার পাঠশালায়। তিনিও জানালেন তিন দিনে কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি। ব্যক্তি-উদ্যোগে কয়েকজন রান্না করা খাবার দিয়েছেন।
আলী বলেন, 'রান্না করা খাবার তো রাখা যায় না। একবেলায় খেয়ে ফেলতে হয়। তাই একবেলা খেলে পরের বেলা উপোস থাকতে হচ্ছে।'
এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি বলে জানান সিলেট সদর উপজেলার মানসিনগর সরকারি শ্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া শরিফা বেগম। বলেন, 'বাড়ি থেকে হাঁড়ি-পাতিল কিছুই আনতে পারিনি। খাবারও আনিনি। এখানে এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণ নিয়েও আসিনি। তাই খুব কষ্টে আছি।' আশপাশের বাসিন্দারা মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসেন বলেও জানান শরিফা।
শুধু এ দুটি আশ্রয়কেন্দ্র নয়, সিলেটের সব আশ্রয়কেন্দ্রের চিত্রই এমন। আশ্রয়কেন্দ্র্রগুলোতে ঠাঁই নেওয়া বানভাসি মানুষেরা ভুগছেন খাবারের তীব্র সংকটে। নগরে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি। নগরের বাইরে সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।এদিকে নগরের ভেতরে ব্যক্তি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খাবার বিতরণ করলেও দুর্গম এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেয়া মানুষরা রয়েছেন সংকটে। জলযানের অভাবে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকও।
সিলেট জেলা প্রশাসনের হিসাবে, জেলায় ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রিত আছেন প্রায় ২ লাখ ৩১ হাজার মানুষ ও ৩১ হাজার গবাদিপশু। আর সিলেট সিটি করপোরেশনের হিসাবে নগরে ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ছয় হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রে নিজের দুটি গরু নিয়ে উঠেছেন জৈন্তাপুরের চারিঘাট এলাকার আসকর মিয়া। তিনি বলেন, 'নিজেদের কোনোমতে খাবারের ব্যবস্থা হলেও গরুগুলো তিন দিন ধরে প্রায় উপোস আছে। আমরা কিছু খাবার পেয়েছি। তার থেকে কিছুটা গরু দুটিকে দিয়েছিলাম। এসব খাবার তারা খেতে চায় না।'
আজ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (আশ্রয়কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্ব) রুহুল আলম বলেন, 'আমরা সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া ২০ টন চাল পেয়েছি। এ ছাড়া কিছু প্যাকেট করা খাবারও পেয়েছি। এগুলো আজ (সোমবার) থেকে বরাদ্দ শুরু হয়েছে।' এর আগে থেকে কাউন্সিলরা ব্যক্তি-উদ্যোগে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বিতরণ করছেন বলে জানান তিনি।
এ পর্যন্ত জেলায় ৬১২ টন চাল, প্রায় আট হাজার প্যাকেট খাবার ও ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান। তিনি বলেন, 'আমরা বন্যাকবলিত মানুষদের উদ্ধার ও সহায়তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। সেনাবাহিনীও এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। তবে নৌকা সংকট ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেক দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে আমাদের আন্তরিকতা ও চেষ্টার ঘাটতি নেই।

বন্ধ থাকবে ওসমানী বিমানবন্দর
রানওয়ে থেকে পানি নামলেও অ্যাপ্রোচ লাইট তলিয়ে থাকায় এখনই সচল হচ্ছে না সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট চলাচল। আরও কয়েক দিন এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। বিমানবন্দর পরিদর্শনে এসে সোমবার দুপুরে তিনি এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, 'আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই বিমানবন্দর চালু করার চেষ্টা করব। তবে পানি না নামলে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।'
এ সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিচালন) এয়ার কমোডর সাদেকুর রহমান বলেন, 'নিরাপত্তার স্বার্থে এই বিমানবন্দরের ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে। আজকে থেকে ফ্লাইট চালুর কথা থাকলেও অ্যাপ্রোচ লাইট তলিয়ে থাকায় আরও কয়েক দিন ফ্লাইট বন্ধ থাকতে পারে।'
রানওয়েতে পানি ওঠায় শুক্রবার ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনদিনের জন্য সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরিবর্তন করা হয় লন্ডন ফ্লাইটের শিডিউল। রোববার থেকে নামতে শুরু করে রানওয়ের পানি। সোমবার প্রায় পুরোটাই নেমে গেছে। তবে এখনও তলিয়ে আছে অ্যাপ্রোচ লাইট।'
স্বাভাবিক হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ
সিলেটে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। সিলেটের কুমারগাঁওয়ে বিদ্যুতের গ্রিড লাইনের উপ কেন্দ্রে পানি ঢুকে শুক্রবার পুরো সিলেট অন্ধকার হয়ে পরে। এরআগের রাত থেকেই সেনবাহিনী, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগ বাধ দিয়ে এই উপকেন্দ্র সচল রাখার চেষ্টা শুরু করে।
রোববার বিদ্যুৎ বিভাগ, সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাদির জানিয়েছেন, কুমারগাও উপকেন্দ্র এখন সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত। ফলে বিদ্যুৎ নিয়ে আর দুশ্চিন্তার কারণ নেি।
সুরমার পানি কমছে, বাড়ছে কুশিয়ার
সুরমার পানি নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বাড়ছে কুশিয়ারার। আর এখনও পানির নিচে জেলার বেশির ভাগ এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ও সিলেট পয়েন্টে কিছুটা কমেছে। এ সময়ে কুশিয়ারার পানি শেরপুর পয়েন্টে কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বেড়েছে ৫ সেন্টিমটার, তবে কমেছে সারি ও লোভা নদীর পানি।
পাউবোর সিলেট কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, 'কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জে বাড়ার কারণে ওই উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে, তবে তা মারাত্মক কিছু হবে না।
নদীর পানি কমতে থাকায় প্লাবিত এলাকাগুলোর পানিও হ্রাস পেতে শুরু করেছে। নগরের নিচু এলাকাগুলো ছাড়া অন্যান্য এলাকা থেকে পানি প্রায় নেমেই গেছে, তবে উপশহর, তালতলা, তেররতন, ঘাসিটুলাসহ বিভিন্ন এলাকা এখনও জলমগ্ন।'
নগরের বাইরের বেশির ভাগ এলাকা এখনও প্লাবিত। দুর্ভোগ বাড়ছে এসব এলাকার মানুষের। নগরের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরে এলেও বাইরের প্লাবিত এলাকাগুলো অন্ধকারে।
দক্ষিণ সুরমার হবিনন্দি এলাকার বাসিন্দা সুজন আহমদ বলেন, 'চার দিন ধরে আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ঘরে এখনও পানি। নারী ও শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছি, কিন্তু ঘরের জিনিসপত্রের নিরাপত্তায় আমাদের এই ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেই থাকতে হচ্ছে।'
বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলার প্রায় পুরোটাই তলিয়ে যায় পানিতে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কও তলিয়ে যায়, তবে এখন পানি অনেকটাই কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং।
তিনি বলেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ধীরগতিতে পানি নামতে শুরু করেছে। বর্ণি এলাকা ছাড়া সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের বাকি এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। পানি কমলেই ক্ষয়ক্ষতির আসল চিত্র জানা যাবে বলে জানান এই ইউএনও।
কোম্পানীগঞ্জ ছাড়াও গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ ও সিলেট সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে পানি বেড়েছে।

হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
হবিগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ৪ উপজেলায় ৩৪টি ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। খোয়াই নদীর পানি সীমান্ত সংলগ্ন বাল্লা পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪৭ সেন্টিমিটার এবং হবিগঞ্জ সদরে মাছুলিয়া পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। যেকোনো সময় শহর রক্ষা বাধ ভেঙে যেতে পারে এ আশঙ্কায় শহরবাসিকে সর্তক থাকার জন্য মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন। এদিকে কুশিয়ারা নদীর পানিও বেড়ে যাওযায় নবীগঞ্জ ও আজমিরিগঞ্জ উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
নবীগঞ্জ উপজেলার ৯টি, লাখাই উপজেলায় ৪টি, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়ন এবং আজমিরিগঞ্জ পৌর এলাকাসহ ৫টি ইউনিয়ন এখন বন্যার কবলে। এদিকে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লুকড়া নামকস্থানে খোয়াই নদীর বাধ ভেঙে পানি হবিগঞ্জ ও লাখাই উপজেলার নিম্নাচল প্লাবিত করছে। সোমবার লাখাই উপজেলার বিভিন্নস্থান ঘুরে দেখা গেছে, বাড়িঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় লোকজন তাদের জানমাল নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটছেন। লাখাই স্বজন গ্রামের নৌকার মাঝি লুৎফুর মিয়া বলেন গত ১ সপ্তাহ ধরে লাখাই ইউনিয়নের বেশ কটি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত। অনেকের কাঁচাঘর বাড়ি পানিতে ভেসে গেছে। অনেকেই খোরাকির ধান পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বাজারে যেখানে ৯শ থেকে ১ হাজার দরে ধান বিক্রি হচ্ছে, সেখানে বন্যা কবলিত এলাকার কৃষকরা ৬' থেকে ৭'শ টাকা দরে গোলার ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ২০০৪ সালের বন্যার পর এতো পানি দেখিনি।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ওই ৪ উপজেলার ১৫ হাজার ২০০ পরিবারের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন । তবে বেসরকারি হিসেবে এর সংখ্যা দ্বিগুণ। সূত্র জানায়, নবীগঞ্জে দুই হাজার ২০০ জন, আজমিরিগঞ্জ দুই হাজার ৪০০, লাখাই ৩৮০ ও বানিয়াচঙ্গে তিন হাজার ৮০৪ জন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, খোয়াই নদীর শহর রক্ষা বাধ নিরাপত্তার জন্য পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, জেলার ১১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোরা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য এ পর্যন্ত ৩৫ টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা, ২ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট পাঠানো হয়েছে। এদিকে আশ্রয় কেন্দ্রে টয়লেট অপ্রতুল থাকায় আশ্রিত লোকজনকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।