'৪০ হাজার টাকায়ও সংসার চালাতে পারছে না, আর আমাদের দৈনিক আয় তো ৬০০ টাকা'

মিজানুর রহমান ভোর ছয়টা থেকে কাজের সন্ধানে মগবাজার শ্রমিকের হাটে এসেছেন। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন কাজ পাননি। রাজমিস্ত্রির কাজ করা মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আজ আর কাজ পাব না। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সময় আয় কমে যাওয়ায় ঋণ করে সংসার চালাতে হচ্ছে।
পটুয়াখালির বাউফল উপজেলায় মিজানুর রহমানের বাড়ি। গ্রামে বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই মেয়ে থাকেন। তার আয়েই সংসার চলে।
মিজানুর রহমান রাজমিস্ত্রির কাজ করেন প্রতিদিন ৮০০ টাকা মজুরিতে। আগে ২০০ টাকায় তিনবেলা খেতে পারলেও দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ায় এখন খরচ হয় ২৫০ টাকা। তার মতো আরও ৪ জন নির্মাণ শ্রমিক মিলে মগবাজার পেয়ারাবাগ এলাকায় ৬ হাজার টাকায় টিনশেডের একরুমে থাকেন।
মিজানুর রহমান বলেন, "পাঁচ বছর আগে ৮০০ টাকা মজুরি ছিল, এখনও ৮০০ টাকা। কিন্তু এই পাঁচ বছরে দ্রব্যমূল্যের দাম তো অনেক বেড়েছে। মাসে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় হয়। সেখান থেকে নিজের খাবার খরচ ও ঘরভাড়া দিতেই চলে যায় ৯ হাজার টাকা। মোবাইল খরচসহ অন্য খরচ চালানোর জন্য এক হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেই।"
তিনি বলেন, "দুইমাস আগে পরোটা ছিল ৫ টাকা, এখন হয়েছে ১০ টাকা। এক প্লেট ভাত ছিল ১০ টাকা, এখন হয়েছে ১৫ টাকা। ডিমভাজি ২০ টাকা ছিল, এখন ২৫ টাকা। ছোট একটুকরো মাছ দিয়ে ভাত খেলেই দাম নেয় ১০০ টাকা। আগে ৮০ টাকায় খেতে পারতাম। প্রতিটি জায়গায় আমাদের খরচ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়ছে না। গত ৪ দিন ধরে কোন কাজ পাচ্ছি না।"
"মেয়ে আগামী বছর এইএসসি পরীক্ষা দিবে। ওর পড়ার খরচ প্রতিমাসে এক হাজার টাকা। সংসার খরচ চালাতে গত মাসে একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ এনেছি। সামনে কিভাবে সংসার চালাবো সেটা বুঝতে পারছিনা।"
মঙ্গলবার সকাল ৭টায় মগবাজার মোড় দিয়ে রেললাইনের দিকে যাবার পথে শ্রমিকের হাটে প্রায় ৫০০ লোক বসে ছিল কাজের জন্য। কারো হাতে ব্যাগ, কারো হাতে কোদাল, কেউবা এসেছেন বালতি নিয়ে। কাঠমিস্ত্রি এসেছেন তাদের সামগ্রী নিয়ে। এর মধ্যে মিজানুর রহমানের মতো অর্ধেকই কাজ না পেয়ে বাসায় ফিরে গেছেন।
এখানকার ২৫ জনের বেশি শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই মাস ধরে তারা কাজ কম পাচ্ছেন। আগে মাসে ২০ দিন কাজ পেলেও এখন ১৫ দিন কাজ পান। তারা বলছেন রড, সিমেন্ট সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় অনেক মালিক কাজ কমিয়ে দিয়েছেন।

আরেক নির্মাণ শ্রমিক বশির হোসেন বেগুনবাড়ি বস্তিতে থাকেন। গত ৫ দিন ধরে কোন কাজ পাচ্ছেন না। বশির হোসেন বলেন, "পত্রিকায় দেখলাম একজন বলছে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেয়েও সংসার চালাতে পারছে না। আর আমরা দৈনিক আয় করি ৬০০ টাকা। সেই কাজও এখন পাচ্ছি না প্রতিদিন। এখন মাসে গড়ে আয় হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কীভাবে এই টাকায় আমাদের সংসার চালাবো। সরকার আমাদের কথা ভাবে না। ভাবলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এমন বাড়াতে পারতো না। এক বছর আগে যে তেল কিনতাম ১০০ টাকা লিটার, সেই তেল এখন হয়েছে ২০০ টাকা। আমরা দিন আনি দিন খাই। প্রতিদিন কাজ না পাওয়ায় এখন ঋণ করে চালাতে হচ্ছে সংসারের খরচ।"
সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ এলাকা থেকে কাজের জন্য এক সপ্তাহ যাবত ঢাকায় এসেছেন মোহাম্মদ আলামিন। সকাল ৭টায় যখন কাজে যাচ্ছিলেন তখন কারওয়ান বাজার এলাকায় কথা হয় আলামিনের সঙ্গে। তিনি জানান, সিলেট থেকে কাজের সন্ধানে একসঙ্গে ১০ জন ঢাকায় এসেছেন। শাহবাগ এলাকার একটি ভবন তৈরীতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তারা। প্রতিদিন মজুরি পান ৬০০ টাকা।
আলামিন বলেন, "এলাকায় বন্যার পানিতে সব ডুবে গেছে। ৪ বিঘা জমির বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ঢাকায় এসে যা আয় হয় সেটা পরিবারের জন্য পাঠাই। ৪ সদস্যের পরিবার কোন রকমের ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি।"
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার রাকিব হোসেন বেগুনবাড়ি বস্তিতে একরুম ভাড়া নিয়েছেন ৩২০০ টাকায়। সেখানে তার মতো ৩ জন শ্রমিক থাকেন। গত ১০ বছর ধরে ঢাকাতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন। রাকিব হোসেন বলেন, খাবারের দাম বাড়ায় গত মাস থেকে হোটেল থেকে আর খাবার কিনে খান না।
তিনি বলেন, "৬ মাস আগেও হোটেলে ১৫০ টাকায় আলু ভর্তা, সবজি ডাল দিয়ে তিন বেলা ভাত খাওয়া যেত। এখন ২০০ টাকা লাগে। তাই বাসায় রান্না করি।"
দুপুরে টিফিনকারিতে করে খাবার সঙ্গে নিয়ে নেন। ডিম দিয়ে আলু রান্না করে সকালে খেয়েছেন, সেই খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে ডিম আলু, টমেটো দিয়ে ভাত খাচ্ছেন রাকিব।
কল্যাণপুর নতুন বাজারের সামনে কথা হয় সাহিনা বেগমের সঙ্গে। আধা কেজি তেলাপিয়া মাছ কিনেছেন ৭০ টাকা দিয়ে। আলু কিনেছেন এক কেজি ২০ টাকা।
তিনি বলেন, স্বামী দিনমজুরের কাজ করে। এখন দুইদিন কাজ করলে চারদিন কাজ খুঁজে পান না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় কষ্ট হচ্ছে সংসার চালাতে। যে মাছ কেনা হয়েছে সেটা আলু দিয়ে তিনদিন রান্না করে খাবেন। সাহিনার কোলে তার এক বছরের সন্তান। সন্তানকে দেখিয়ে তিনি বলেন, "বাচ্চাটাকে এখন সপ্তাহে একটা ডিমও কিনে খাওয়াতে পারি না। দুই মাস আগেও প্রতি সপ্তাহে ২টি ডিম খাওয়াতাম। তখন সবকিছুর দাম এত বাড়েনি।"

কল্যাণপুর বস্তিতে থাকেন সাহিনা বেগম। সাহিনা জানান, ঈদুল আযহার সময় কেউ কোরবানির মাংস দিলে সেটা খাওয়া হয়। দাম বেশি হওয়ায় গরুর মাংস কেনেন না দুই বছর ধরে। গত ঈদুল ফিতরে সর্বশেষ এক কেজি মুরগি কিনেছিলেন।
কারওয়ান বাজারে আলু, পিঁয়াজ সহ ট্রাক থেকে নামানো বিভিন্ন সবজি বাছাইয়ের কাজ করেন জরিনা বেগম। তিনি বলেন, "সারাদিন কাজ করলে ৩০০ টাকা আয় হয়। শরীর অসুস্থ থাকায় আজকে শুধু সকালে কাজ করেছি, সেখানে ১০০ টাকা আয় হয়েছে। যা আয় হয় সেই টাকা দিয়ে কোনমতে খেয়ে বেঁচে আছি।"
পরিবারে কেউ নেই জরিনা বেগমের। ঘরভাড়া দেয়ার মতো টাকা আয় করতে না পেরে কারওয়ান বাজার সবজির আড়তেই রাতে ঘুমিয়ে থাকেন। জরিনা বেগম বলেন, "আমার মতো এমন অনেক নারী সবজির আড়তেই রাতে ঘুমিয়ে থাকেন।"
আনোয়ারা বেগম কল্যাণপুর এলাকায় দুইটি বাসায় রান্নার কাজ করেন। তার স্বামী রিক্সা চালান। ২৫০০ টাকা ভাড়ায় থাকেন কল্যাণপুর বস্তিতে। আনোয়ারা বলেন, "দুই বাসায় রান্নার কাজ করে ৩ হাজার টাকা বেতন পান। আর স্বামী রিকশা চালিয়ে যা আয় করতো সেই টাকা দিয়ে ডালভাত খেয়ে ৬ জনের পরিবার চলতো। এখন সেই উপায়ও নেই। অনেক সময় এমন হয় চাল কেনারও টাকা থাকে না। তখন বাকিতে চাল কিনতে হয়।"