জামালপুরে কৃষিকাজ করে পরিবারে সচ্ছলতা আনছেন নারীরা

বাড়ির পাশের ছোট্ট একখণ্ড জমিতে পাওয়ার টিলার চালিয়ে জমি চাষ করছিলেন জামালুপুর সদর উপজেলার জামিরা গ্রামের বাসিন্দা শান্তি বেগম। আশপাশের দু-তিন বাড়ির প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তাকে। যদিও নিজ গ্রামের বাইরেও শান্তি বেগমের পাওয়ার টিলার চালিয়ে জমি চাষের খবর চাউর হয়েছে বছর দুয়েক ধরেই।
শান্তি বেগম টিবিএসকে জানান, এবারের বোরো মৌসুমে তিনি ও তার স্বামী মিলে প্রায় ১০০ বিঘা জমি চাষ করেছেন, এজন্য তারা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। এরমধ্যে পাওয়ার টিলারের জ্বালানি ডিজেল ক্রয় বাবদ খরচ হয় ৭০ হাজার টাকা, বাকিটা তাদের আয়। ২০২০ সালে কেনা এই যন্ত্রটি তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছে।
জামালপুরের সদর উপজেলা, দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শান্তি বেগমের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক নারীই এখন পুরুষের পাশাপাশি কৃষিখাত থেকে আয়ের পথ তৈরি করছেন। পুরুষেরা যখন অন্য কাজ করছে, তখন নারীরা মাঠে নানা ধরনের ফসলের চাষ করছে। কেউ করছেন গতানুগতিক বাড়ির আঙিনায় সবজি বাগান। আবার শান্তি বেগমের মতো কেউ কেউ পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে আয় করে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে ভূমিকা রাখছেন।
জামালপুরের ৩টি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে 'নিউট্রিশন সেন্সেটিভ ভ্যালু চেইন ফর স্মল হোল্ডার ফার্মার্স (এনএসভিসি) 'শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ। এ প্রকল্পে সমর্থন দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া সরকারের অস্ট্রেলিয়ান এনজিও কর্পোরেশন প্রোগ্রাম (এএনসিপি)।
অষ্ট্রেলিয়া সরকার এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে ৫.৭৭ মিলিয়ন ডলার। যেখানে বাস্তবায়ন অংশীদ্যার হিসেবে কাজ করছে উন্নয়ন সংঘ। ৬ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছে এবং এর কাজ চলবে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ হাজার পরিবারের নারী-পুরুষ আয়বৃদ্ধিমূলক কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। তাদের নিয়ে ৮০০টি প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। আয়বর্ধক কৃষিকাজে জড়িতদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই হলেন নারী।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের তথ্য বলছে, যেসব পরিবারের নারী-পুরুষ এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭৪.১০ শতাংশ পরিবার তাদের আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। তাড়া উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত একটি ভ্যালু চেইন তৈরি করেছে যাতে করে তারা সহজে ফসল চাষের উপকরণগুলো পান এবং উৎপাদিত ফসলও বিক্রি করতে পারেন। দেখা গেছে, এর মধ্য দিয়ে যেসব পরিবারের আয় বেড়েছে, তারা আগে মাসিক আয় করতো ১০ হাজার টাকা; যা এখন বেড়ে ১৭,৫০০ টাকা বা তারও বেশি হয়েছে।
বাড়তি এই অর্থে তারা পরিবারে পুষ্টিকর খাবারের যোগাড়, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও স্বাস্থ্যের পেছনে বাড়তি ব্যয় করতে সহায়তা পাচ্ছে। এই মূল্য চক্র কার্যক্রমের (ভ্যালু চেইন অ্যাক্টিভিটি) মাধ্যমে প্রডিউসার গ্রুপের ৭৬.৪০ শতাংশ পরিবার সন্তানের স্বাস্থ্যের পেছনে খরচ করতে পারছে। আগে এই গ্রপের ৪৫.১০ শতাংশ পরিবার এই ব্যয় করতো।
এই গ্রুপগুলোর মধ্য থেকে ১২২ জন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠেছেন। তাদের অনেকে প্রকল্প থেকে কৃষি যন্ত্র কেনায় নির্দিষ্ট দামের ২৫ শতাংশ ভর্তুকি, বিনামূল্যে উন্নতমানের বীজ, ব্যবসা বা চাষাবাদের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তাড়া উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বাজারের সঙ্গে সংযোগও তৈরি করেছে।
জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের মোছা. কামরুন্নাহার ৯৫ হাজার ৫০০ টাকায় একটি পাওয়ার টিলার কিনেছেন। এর ২৫ শতাংশ তিনি সহায়তা হিসেবে পেয়েছে ওয়ার্ল্ড ভিশনের এই প্রকল্প থেকে।
কামরুন্নাহার টিবিএসকে বলেন, 'প্রতি বছর প্রায় ১০০ বিঘা জমি চাষ করা সম্ভব হয়। এছাড়াও একটি মাড়াই যন্ত্র রয়েছে। এই দুটি যন্ত্রের মাধ্যমে যে আয় হয়- তা দিয়ে ভালোভাবেই সংসার খরচ চলে যাচ্ছে।'
এই গ্রুপগুলোর মধ্য থেকে ১০৮টি কমিউনিটি সেলস এজেন্ট (সিএসএ) তৈরি করা হয়েছে। তারা প্রডিউসার গ্রুপগুলোকে বীজ, সার, কীটনাশক এনে দেয়া এবং উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে।
এজেন্টদের একজন জামালপুর সদর উপজেলার জামিরা গ্রামের ফরিদ উদ্দিন। তার ইউনিয়নে ২১৯ জন কৃষকের গ্রুপ রয়েছে। যাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের উৎপাদিত পণ্য পাইকারদের কাছে পৌছে দেন এবং কৃষক গ্রুপের প্রয়োজন অনুযায়ী সার ও বীজ সরবরাহ করেন।
তিনি বলেন, '১০০ মন ফসল বিক্রির জন্য পাইকার ঠিক করে দিলে কৃষকদের থেকে ৮০০-১০০০ টাকা কমিশন পাই'।
প্রডিউসার গ্রুপগুলোয় নারী ও পুরুষ উভয়েই ধান, ভু্ট্টা, মরিচ ও বেগুনের চাষ করছেন। এমন আরেক নারী হলেন- শিখা। তিনি এবার ২০ শতক জমিতে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান লাগিয়েছেন। এ ধান লাগানোর পরামর্শ তিনি পেয়েছে এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে। এর বাইরে তিনি মরিচের চাষ করছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা নিয়মিত পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ পাচ্ছি ফসল উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে। আবার এজেন্টরা আমাদেরকে ভালো বীজ এনে দিচ্ছে। যে কারণে উৎপাদনও ভালো হচ্ছে।'
মিতু আক্তার নামের আরেক নারী উদ্যোক্তা বলেন, 'আমরা এখন ফসল উৎপাদনের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত কোথায় কত খরচ হচ্ছে সবটাই হিসাব করছি। ফলে উৎপাদিত ফসল বিক্রির পর আমরা মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছি- কত আয় হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এনএসভিসি প্রকল্প ব্যবস্থাপক অসীম আর. চ্যাটার্জি টিবিএসকে বলেন, 'আমরা ছোট কৃষি পরিবারগুলোর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছি। এজন্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি এবং এলাকাভিত্তিক ভ্যালু চেইন তৈরির জন্য কাজ করে চলেছি।'